সংরক্ষণ প্রশ্নে দলিতদের নানা জাতে ভেঙে ফেলবার রায় সুপ্রিম কোর্টেরঃ একটি পর্যবেক্ষণ

Bhim Army chief Chandra Shekhar Azad with others during a protest at Jantar Mantar amid ‘Bharat Bandh’ against the Supreme Court’s August 1 decision on the issue of SC-ST reservation in New Delhi on Wednesday (August 21, 2024). | Photo Credit: PTI

 

By Raktim Ghosh

খবর তো হয়েছিল। পত্রপত্রিকায় হয়েছিল খানিক আলোচনাও। কিন্তু সেসব আমাদের শহুরে ভদ্রলোক মনে বিশেষ দাগ কাটতে পারেনি। প্রথমত বিষয়টা দলিতদের মধ্যেকার, সেখানে ‘আমরা’ খামোকা ঘামিয়ে করবো কী! তাছাড়া সংরক্ষণের সুযোগ সুবিধা নিয়ে দলিতরা যেভাবে ‘আমাদের’ বঞ্চিত করে চলেছে! এই ‘আমরা’ আর ‘আমাদের’ অপছন্দের বিষয় বটে সর্বোচ্চ আদালতের এই রায় প্রসঙ্গ। এই ‘আমরা’ আর ‘আমাদের’ বাইরেও যে একটা বিরাট বড়ো ভারতবর্ষ রয়েছে, সেটা ‘আমরা’ বিশ্বাসই করতে চাই না। ভাবলেই নিজেদের কেমন নিরাপত্তাহীন মনে হয়। বাঁধা ধরা ছক চিন্তার বাইরের এক অ্যালিয়েন পৃথিবী। সেই পৃথিবীর খবর এটা। যাই হোক, তবুও তো খবরের কাগজ আলো করা খবর বটে! আসুন দেখাই যাক না, আমাদের কিছু আসে যায় কিনা।

প্রথমেই বলি সুপ্রিম কোর্টের যে রায় নিয়ে আজকের আলোচনা, সেই রায়টি সুপ্রিম কোর্ট দেয় ১ আগস্ট, ২০২৪। হ্যাঁ, এখনও তিন মাস হয়নি। এই রায়ের মোদ্দা কথা হলো, এখন সরকারি চাকরি আর সরকারি স্কুল-কলেজে সিডিউলড কাস্ট ও সিডিউলড ট্রাইবস্-রা যে সংরক্ষণ পাচ্ছেন, সেটায় বিভাজন আনা হবে। সংরক্ষণে বিভাজন! কীভাবে? সিডিউলড কাস্ট বা দলিতদের মধ্যে বিভিন্ন জাতগুলোকে আলাদা করা হবে। কোন জাত বা উপজাত এগিয়ে বা পিছিয়ে সেটা বিচার করা হবে। তারপর পিছিয়ে থাকা জাতগুলো যাতে সংরক্ষণের বেশির ভাগটা পায় সেটার ব্যবস্থা করা হবে।

তবে এই রায়টা যে হঠাৎ করে আকাশ থেকে পড়লো, এমন নয় ব্যাপারটা। তখন অন্ধ্রপ্রদেশ ভাগ হয়নি। ১৯৯০ সাল। দলিতদের মধ্যেকার মাদিগা বলে একটা সম্প্রদায় সেখানে প্রথম সিডিউলড কাস্টদের মধ্যে সাব-ক্যাটাগোরাইজেশনের দাবি তোলে। মানে ওই ভাগাভাগির দাবি। পিছিয়ে থাকা দলিত জাতগুলোকে সংরক্ষণের বেশি ভাগ দেওয়ার দাবি। তো সেই সময় মাদিগারা এসসি (সিডিউলড কাস্ট)-দের মধ্যে নিজেদের জনসংখ্যার যে অনুপাত, সেই হিসাবে সংরক্ষণের ভাগ দাবি করে। দলিত হিসাবে নয়, নিজেদের পরিচয় দিতে শুরু করে তারা মাদিগা হিসাবে। তৈরি করা হয়, মাদিগা রিজার্ভেশন পোরাতা সমিতি। এরপর থেকে এই গোষ্ঠীর অনেক মানুষই নিজেদের নামের পিছনে মাদিগা পদবিটি ব্যবহার করতে শুরু করে দেন। মাদিগা শব্দটিই হয়ে ওঠে আত্মপরিচয়ের হাতিয়ার।

এই আন্দোলনটি পরিচিত ছিল মাদিগা ডান্ডোরা নামে। আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন মন্দ কৃষ্ণ ইয়াল্লাইয়াহ। ইয়াল্লাইয়াহ অবশ্য পরে পদবিটি পরিবর্তন করেছেন। তাঁর বর্তমান নাম, মন্দ কৃষ্ণ মাদিগা। জানা যায় তিনি পূর্বতন সিপিআই(এমএল) জনযুদ্ধ গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু করমচেডু এবং সুন্দডু গণহত্যার পর তিনে সেই আন্দোলন ছেড়ে দলিত আন্দোলনে অংশ নিতে শুরু করেন। অবশ্য সমগ্র দলিত আন্দোলনের অংশ হিসাবে নয়, নিজ জাতের আত্মপরিচয়ের আন্দোলনে।

প্রসঙ্গত বলা চলে, তেলেঙ্গানা এলাকার সিডিউলড কাস্ট ভোটের ৬০ শতাংশই হলো মাদিগাদের। তা সত্ত্বেও ভোটে দাঁড়িয়ে মন্দ কৃষ্ণ বিপুল ভোটে পরাস্ত হন। হেরে যাওয়ার পরেও একটা জিনিস তিনি অর্জন করেছিলেন। দলিতদের সাব ক্যাটাগোরাইহেশন-এর সমর্থনে গড়ে উঠেছিল একটা স্পষ্ট মাদিগা ভোট ব্যাংক। একটা সংগঠিত শক্তি প্রদর্শনের জায়গা এভাবেই তৈরি হয়েছিল।

এরই ধারাবাহিকতায় দলিতদের মধ্যে মাদিগাদের বিশেষ সংরক্ষণ পাওয়ার দাবি শক্তি পেতে থাকে। বিষয়টি খতিয়ে দেখবার জন্য ১৯৯৬ সালে অবিভক্ত অন্ধ্রপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু, বিচারপতি রামচন্দ্র রাজুর দায়িত্বে একটি কমিশন গঠন করেন।

যথা সময়ে রামচন্দ্র রাজুর কমিশন বিষয়টি নিয়ে রাজ্য সরকারকে নিজের সুপারিশ জমা দেয়। এই সুপারিশে অন্ধ্রপ্রদেশের সিডিউলড কাস্টদেরকে চারভাগে ভাগ করবার কথা বলা হয়। প্রতিটা ভাগের জনসংখ্যার যা অনুপাত, সেই অনুযায়ী তাদের জন্য কোটা বা সংরক্ষণ নির্দিষ্ট করতে বলা হয়।

অন্ধ্র সরকার এই সুপারিশ মেনে নেয়। ১৯৯৭ সালে দুটি সরকারি নির্দেশনামা জারি করা হয়। সংরক্ষণ পাওয়ার নিরিখে সিডিউলড কাস্টদেরকে সেই চারভাগে ভাগ করা হয়। নাম দেওয়া হয়, এ, বি, সি এবং ডি। মাদিগারা জায়গা পান গ্রুপ এ-তে। সিডিউলড কাস্টদের জন্য প্রাপ্য সংরক্ষণের মধ্যে একটা বড়ো ভাগ দেওয়া হয় মাদিগাদের।

কিন্তু অন্ধ্রপ্রদেশ সরকারের এই নির্দেশ বেশিদিন লাগু থাকতে পারেনি। ২০০৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট এই সরকারি নির্দেশনামা বাতিল করে দেয়। সর্বোচ্চ আদালত জানিয়ে দেয়, সিডিউলড কাস্টদের মধ্যে এই ধরনের সাব-ক্যাটাগোরাইজেশন করার অধিকার রাজ্য সরকারের নেই। শুধু তাই নয়, সুপ্রিম কোর্টের এই রায় একদম স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করে, সিডিউলড কাস্ট হলো আভ্যন্তরীণভাবে সমস্তত্ব একটা গোষ্ঠী। অর্থাৎ সিডিউলড কাস্টদের মধ্যে ওরকম ভাগাভাগি করা যাবে না। ঐতিহাসিকভাবে প্রান্তিক গোষ্ঠী হিসাবে সংবিধানে এঁদেরকে স্বীকার করা হয়েছে। এই গোষ্ঠীর মধ্যে ভাগাভাগি করে কোনও অংশকে আলাদা করে দেখালে, সেই কাজটা সংবিধানসম্মত হবে না। সকলের সমান অধিকারের যে ধারণা সংবিধানে রয়েছে, সেটাকে খাটো করা হবে।

সুপ্রিম কোর্টে সিডিউলড কাস্ট সাব-ক্যাটাগোরাইজেশনের দাবি মুখ থুবড়ে পরলেও, দাবিটা ছড়িয়ে যায় পাশের রাজ্য কর্ণাটকে। মাদিগার ও হোলেয়ার, দলিতদের এই দুই জাতের মধ্যে শুরু হয় সংরক্ষণ নিয়ে সংঘাত। দলিতদের মধ্যে সংঘাত চালু হয় তামিলনাড়ুতেও। দলিতদের মধ্যে তুলনামূলক শক্তিশালী পারাইয়ার ও পাল্লার জাতের বিরুদ্ধে, তুলনায় পশ্চাদপদ চাকলাইয়ার এবং অরুন্থাথিয়ার জাতের সংঘাত তৈরি হয়।

তবে স্বাধীন ভারতে যে দলিতদের মধ্যেকার কোনও অংশকে আগে বিশেষ সংরক্ষণ দেওয়া হয়নি, এমনটা সত্যি নয়। ১৯৭৫ সালে পাঞ্জাবে রাজ্য সরকার অর্থনৈতিক এবং শিক্ষাগত ক্ষেত্রে ভয়ানক ভাবে পিছিয়ে থাকার জন্য, জাস্টিস আর.এন. প্রসাদ কমিটির সুপারিশ মেনে বাল্মীকি এবং মজহবি শিখ সম্প্রদায়কে বিশেষ সংরক্ষণ প্রদান করে। তারপর ১৯৯০ সালে হরিয়ানায় জাস্টিস গুরনাম সিংহ কমিশনের সুপারিশে সিডিউলড কাস্ট লিস্টকে ব্লক এ এবং ব্লক বি-তে ভাগ করা হয়। ৩৬ টি জাতকে ব্লক এ-তে রাখা হয় এবং ব্লক বি-তে তখনও পর্যন্ত সর্বাধিক সুবিধা প্রাপ্ত চামার জাতকে রাখা হয়।

আর অন্ধ্রপ্রদেশের এই সিডিউলড কাস্ট সাব-ক্যাটাগোরাইজেশনের দাবি ধাক্কা খাওয়ার পরও আর বেশ কিছু রাজ্যে রাজ্য সরকার গঠিত কমিশন সাব-ক্যাটাগোরাইজেশনের সুপারিশ করে। যেমন ২০০৩ সালে মহারাষ্ট্রে লাহুজি সাল্ভে কমিশন, মাঙ্ জাতের মধ্যে ভাগ করে সংরক্ষণ দেওয়ার সুপারিশ করে। ২০০৫ সালে কর্ণাটকে জাস্টিস এ.জে. সদাশিব কমিশন, ১০১ টা জাতকে ৪টে ভাগ ভাগ করার সুপারিশ করে। প্রতিটি ভাগ ১৫ শতাংশ করে সংরক্ষণ পাবে, এমনটা সুপারিশ করা হয়। ২০০৭ সালে বিহারে মহাদলিত কমিশন ১৮ টি অতি প্রান্তিক জাতকে চিহ্নিত করেছিল। এগুলির মধ্যে ছিল, মুসাহার, ভুঁইয়া, ডোম এবং রাজোয়ার। আবার ২০০৮ সালে তামিলনাড়ুতে জাস্টিস জনার্থনম কমিটির পক্ষ থেকে সুপারিশ করা হয়, অরুন্থাথিয়ার সম্প্রদায়ের জন্য পৃথকভাবে সংরক্ষণের বন্দোবস্ত করার। যদিও ২০০৪ সালে সংবিধানের প্রশ্নকে সামনে রেখে সুপ্রিম কোর্ট সিডিউলড কাস্ট সাব-ক্যাটাগোরাইজেশনের বিরুদ্ধে যে রায় দেয়, তার সামনে এই ধরনের কোনও সুপারিশই কার্যকর হতে পারেনি।

এবার একটা প্রশ্ন খেয়াল করা যেতে পারে। সেটা হলো মোটামুটিভাবে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে নব্বইয়ের দশকে ভারতে খোলা বাজারের জমানার শুরু। ঠিক সেই সময়েই মণ্ডল কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ এবং সংরক্ষণ নিয়ে প্রবল আলোড়ন। আর ঠিক এই সময় কালের আর একটা বড়ো বৈশিষ্ট্য হলো রাজনৈতিক হিন্দুত্বের প্রবল উত্থান। রাজনৈতিক হিন্দুত্বের প্রতিনিধিত্বকারী অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ চিরাচরিতভাবে প্রবল ব্রাহ্মণ্যবাদী এবং দলিত বিরোধীরূপেই এতো যুগ পরিচিত ছিল। আম্বেদকরের প্রতিও ছিল প্রবল বিদ্বেষ। কিন্তু খোলা বাজারের আবহাওয়ায় আরএসএস-এর দলিত ও আম্বেদকর প্রশ্নে নীতিগত কিছু অবস্থান বদল বেশ চোখে পড়ার মতো ভাবে সামনে এলো। হঠাৎ তাদের দলিত ও আম্বেদকর প্রেম উথলে উঠলো এবং… দলিতদের মধ্যে ডিভাইড অ্যান্ড রুল কায়েম করবার কিছু নয়া উদ্যোগ ওরা নিতে শুরু করলো। এই পরিপ্রেক্ষিত থেকেও সিডিউলড কাস্টদের মধ্যেকার সাব-ক্যাটাগোরাইজেশন-এর প্রশ্নকে দেখাটা জরুরি।

আরএসএস দলিতদের মধ্যে ডিভাইড অ্যান্ড রুল কায়েম করার চেষ্টায় দুটি পদক্ষেপ নেয়। প্রথমে তাঁরা দলিতদের জন্য সোশ্যাল হারমনি প্ল্যাটফর্ম নামে একটা মঞ্চ বানায়। সেখান থেকে প্রচুর বইপত্র বার করে, যেগুলোর উদ্দেশ্য আম্বেদকরকে যতটা পারা যায় গেরুয়াকরণ করা। দ্বিতীয় পদক্ষেপ ছিল, আম্বেদকরের নিজের জাত অর্থাৎ মাহার এবং দলিতদের মধ্যে যারা এগিয়ে যেতে পেরেছেন সংরক্ষণের সুবিধা নিয়ে, তাঁরা ছাড়া অন্য জাতগুলোর আইকনদের সামনে নিয়ে আসা। এই জাতগুলোর আইডেন্টিটিকে আলাদাভাবে ক্লেইম করা। গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ সন্দেহ নেই। কতটা সামাজিক গবেষণা করলে কু উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এই ধরনের বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়, সেটা নিঃসন্দেহে সকলের নজর করা উচিত।

মজার বিষয় হলো আম্বেদকরাইট দলিতদের কাছে উপেক্ষিত এই অন্যান্য দলিতেরা ব্রাহ্মণ্যবাদীদের প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে পড়লেন এই কারণে। ভারতে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশরাও স্তর বিন্যস্ত সমাজের সুযোগ নিয়ে, নিপীড়িতের মধ্যকার বিভাজনকে সফলভাবে কাজে লাগিয়ে গেছে। এখানে ব্রাহ্মণ্যবাদের ঐতিহ্যগত সাফল্য। আম্বেদকরের জাতব্যবস্থার বিনাশের ডাকের গুরুত্ব এখানেই। উপমহাদেশের আর্থ-সামাজিক শোষণ কাঠামোর গোরা ধরে টান মারা যায় একমাত্র এই ডাকে সাড়া দিয়েই। দুর্ভাগ্যের বিষয় আম্বেদকরকে ভগবান বানিয়ে ফেলা দলিত অংশটাও এই ডাকটাকে নিছকই কথার কথা মনে করে বসে থেকে ব্রাহ্মণ্যবাদের শোষণ ক্ষেত্রকে বড়ো বেশি মান্যতা দিয়ে ফেলছেন।

যাই হোক। তো আরএসএস-এর কৌশলে আম্বেদকরবাদী দলিত এবং অন্যান্য দলিতদের মধ্যে একটা বিভাজন সম্ভাবনা দেখা দিল। কিন্তু নিছক সম্ভাবনাই নয়, ব্যাপারটা বাস্তবেও ওদের কাজে লেগে যায়। ২০১৪তে এই নীতি বিজেপিকে দলিত ভোট পাওয়ার প্রশ্নে বিশাল সাফল্য এনে দেয়। ২০১৪ আর ১৯-এর নির্বাচনে তাই বিজেপি-র নির্বাচনী ইশতেহারে দলিতদের সাব-ক্যাটাগোরাইজেশন জায়গা পায়।

২০১৭ সালে বিজেপি সরকার ওবিসি-দের সাব-ক্যাটাগোরাইজেশনের জন্য জাস্টিস জি. রোহিণী কমিশন বসায়। পরে এই কমিশনের আওতায় সিডিউলড কাস্ট সাব-ক্যাটাগোরাইজেশন-কেও নিয়ে আসা হয়। দলিতদের মধ্যে কোন কোন জাত সংরক্ষণের সুযোগ সুবিধা বঞ্চিত সেটা দেখার জন্য নাকি এমন সিদ্ধান্ত।

২০২৪ সালের ১৯ জানুয়ারি তেলেঙ্গানায় নির্বাচনী প্রচারে নরেন্দ্র মোদী আবারও প্রতিশ্রুতি দেন সিডিউলড কাস্ট সাব-ক্যাটাগোরাইজেশন ব্যাপারটা নতুন করে পরীক্ষা করে দেখবার। এই প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে মাদিগা রিজার্ভেশন পোরাতা সমিতি বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি-কে সম্পূর্ণ সমর্থন দেওয়ার কথা ঘোষণা করে। তো সেই প্রতিশ্রুতি মতো মোদী সেক্রেটারিয়েট স্তরের ৫ সদস্যের একটা কমিটি তৈরি করেন, দেশের ১২০০-এর বেশি সিডিউলড কাস্ট সম্প্রদায়ের মধ্যে কীভাবে সংরক্ষণ ব্যাপারটাকে সুষমভাবে বণ্টন করা যায়, সেই প্রশ্নে।

সুতরাং এই হলো হিন্দুত্ববাদীদের দলিতদের ভাগ করে ভোটে জেতারা নীতি। তো এবার ফেরা যাক ১ আগস্টে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের প্রশ্নে। ওইদিন সুপ্রিম কোর্টের ৭ সদস্যের একটা সাংবিধানিক ডিভিশন বেঞ্চ এসসি সাব ক্যাটাগোরাইজেশনের বিষয়ে রায়টি দিয়েছে। ২০০৪ সালে ইভি চিন্নাইয়াহ বনাম অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায় কিন্তু সিডিউলড কাস্টের সাব ক্লাসিফিকেশনের বিপরীতে ছিল, সেটা আমরা আগেই দেখেছি। এবার রায় হয় জাজেদের ৬-১ সংখ্যাগুরুতার বিচারে। মানে ৬ জন জাজ ছিলেন সাব-ক্যাটাগোরাইজেশনের পক্ষে। ৭ জনের বেঞ্চে মাত্র একজন বিচারপতি বেলা ত্রিবেদী এই রায়ের বিরোধিতা করেন।

মূল রায়টি দান করেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং বিচারপতি মনোজ মিশ্র। এই রায়ের সপক্ষে সঙ্গতিপূর্ণভাবে আরও ৪ বিচারপতি আলাদা আলাদাভাবে তাঁদের রায় দান করেন।
নিজের দেওয়া রায়ের পক্ষে প্রধান বিচারপতির যুক্তি হলো, সংবিধানের ১৪ নং ধারায় বলা আছে, “আইনের প্রয়োজনে একই অবস্থায় রাখা হয়েছে” এমন শ্রেণি না হলে, সেই ধরনের শ্রেণির সাব ক্লাসিফিকেশন হবে। যদিও বাস্তবে সংবিধানের ১৪ নং ধারা কিন্তু মিনি ক্লাসিফিকেশনের বিরুদ্ধে সতর্ক করেছে, কারণ সেটা সমানতার ধারণার পরিপন্থী। সাংবিধানিকভাবে শুধুমাত্র সেই ধরনের ক্লাসিফিকেশনকে ভ্যালিড বলা হয়েছে, যেগুলি প্রাসঙ্গিক এবং কোনও বৈধ লক্ষ্যকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।

এদিকে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি আরও বলছেন, সিডিউলড কাস্ট কোনও সমস্তত্ব গোষ্ঠী বা শ্রেণি নয়, কারণ বিভিন্ন জাতগুলি বিভিন্ন মাত্রায় পিছিয়ে রয়েছে। এখানেই যে প্রশ্নটা আসে, এই পিছিয়ে থাকা বলতে তিনি কী বোঝাতে চাইছে? মাপকাঠিটা কী? বাস্তবে সিডিউলড কাস্ট ধারণাটাই তো তৈরি হয়েছে একমাত্র অস্পৃশ্যতার প্রশ্নের উপর দাঁড়িয়ে। অর্থাৎ ঐতিহাসিকভাবে সামাজিক বৈষম্য এক্ষেত্রে নির্ধারক মাপকাঠি। সিডিউলড কাস্ট প্রসঙ্গে অর্থনৈতিক বা শিক্ষাগতভাবে পিছিয়ে থাকাটা কোনও বিচারের মাপকাঠি নয়।
তাছাড়া সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির রায় সংবিধানের ৩৪১ নং ধারার সঙ্গেও সংযুক্ত। এই ধারা অনুসারে দেশের রাষ্ট্রপতি কোনও রাজ্য বা কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের মধ্যেকার কিছু জাত বা শ্রেণিকে সিডিউলড কাস্ট হিসাবে ঘোষণা করতে পারে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের বিষয়কে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে কেন্দ্রীয়ভাবে দিব্যি বিভাজনের খেলাটা চালিয়ে যাওয়া যাবে।

 
এদিকে অন্য বিচারপতি বিআর গাভাই তো সরাসরি বলেছেন, ইন্দ্র সাহনি বনাম ভারত যুক্তরাষ্ট্র ১৯৯২-এর মামলায় আদার ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস গ্রুপের মধ্যেকার এগিয়ে থাকা অংশকে যেভাবে তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার কথা হয়েছিল, সেটা সিডিউলড কাস্ট ও সিডিউলড ট্রাইবদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হওয়া উচিৎ। যদিও এই কেসে ১৯৯২ সালে সুপ্রিম কোর্ট বিশেষভাবে জানিয়েছিল, সিডিউলড কাস্ট বা সিডিউলড ট্রাইবদের প্রশ্নে এই রায় কাজ করবে না। এটাই সংবিধানের স্পিরিট হওয়ার কথা। প্রসঙ্গত আবারও বলা যে, সংবিধানে অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে থাকা শ্রেণির মাপকাঠিতে কোনও সংরক্ষণের কথা বলা নেই। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মাধ্যমে ১০ শতাংশ সংরক্ষণ মোদীর বিজেপি সরকার চালু করেছে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষদের জন্য। সংরক্ষণের প্রশ্নটাকে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকার প্রশ্নের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে লাভটা কী হচ্ছে! আসবো সেই প্রশ্নে খানিক বাদে। তার আগে বরং দেখে নিই যে সরকারি ক্ষেত্রে এই সংরক্ষণ লাগু হওয়ার কথা সেখানকার বাস্তব হালটা কেমন।

২০২৩ সালের অ্যানুয়াল স্ট্যাটাস অফ এডুকেশন রিপোর্ট বলছে, প্রথমিক স্তরে সরকারি স্কুলের ভাগ ছিল ৮৭ শতাংশ ২০০৬ সালে, ২০২০তে সেটা দাঁড়িয়েছে ৫২ শতাংশে। মানে প্রাথমিক শিক্ষায় সরকারি ক্ষেত্রের ভাগ কমছে। এই রিপোর্ট আরও বলছে, আঞ্চলিক ভাষায় পড়াতে জোর দেওয়ার বিষয়টাও তেমন কোনও কাজে লাগেনি। ১৪ থেকে ১৮ বছরের মধ্য বয়সের গ্রামীণ যুবরা স্থানীয় ভাষায় ক্লাস টু-এর পাঠ্য বইও গড়গড় করে পড়তে পারে না। অর্ধেকের বেশি ছাত্রছাত্রী ভাগ করতে সমস্যায় পড়ে। মাত্র ৫৭.৩ শতাংশ ছাত্রছাত্রী ইংরাজিতে পড়তে পারে। যারা পড়তে পারে, তাঁদের মধ্যে মাত্র ৭৫ শতাংশ শব্দের মানে বুঝতে পারে।

অর্থাৎ বাস্তবে দ্রুত গতিতে কমে যাচ্ছে সরকারি শিক্ষার ক্ষেত্রের মান। সেইদিকে কোনও নজর নেই। বরং বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বেসরকারি ক্ষেত্রের ভাগ। ব্যাপারটা এমন যে, বেসরকারি হলে পরিষেবা ভালো হবে। আর পরিষেবাটা পণ্য। সেটা শিক্ষা হোক, স্বাস্থ্য হোক এমনকি অস্তিত্বটুকু টিকিয়ে রাখার প্রশ্নটাও হোক না কেন। খোলা বাজারের নীতির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে সরকারি ক্ষেত্রকে আরও বেশি বেশি করে অকেজো করে ফেলা হচ্ছে। সরকারি চাকরির পরিসর যে গত বিশ-ত্রিশ বছরে ভয়ংকরভাবে কমেছে সেটাও বলার অপেক্ষা রাখে না। ২০০৩ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরি ১৫.৬ লক্ষ কমেছে। অর্থাৎ ৪৫ শতাংশ। এসসি কর্মীর সংখ্যা এই সময়ে কমেছে ২.৮৫ লাখ। অর্থাৎ ৪৭ শতাংশ। কিন্তু ইঁদুর দূর দৌড়তে হবে ওখানেই। দলিত ও জনজাতিদের সামনে সরকারি ক্ষেত্রে সংরক্ষণের এই মূলা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। উন্নত পরিষেবা কিনবে উঁচু জাতের বাবু লোকেরা। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। খেলা আরও আছে।

সংরক্ষণের প্রশ্নটাকে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকার প্রশ্নের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে লাভটা হচ্ছে ঠিক এখানেই। কেমন ভাবে? যুগ যুগ ধরে সামাজিকভাবে অবদমনে রাখা দলিত ও জনজাতিদের সংরক্ষণের অধিকারটাকে বিশাল একটা পাওয়া দেখিয়ে বলা হচ্ছে, এঁদের জন্যই বাকিরা শিক্ষা বা চাকরি পাচ্ছে না। এঁরাই সব জায়গা খেয়ে নিচ্ছে। সমাজে দলিত ও জনজাতি বিরোধী বিদ্বেষে সেটা আরও হাওয়া যোগাচ্ছে। সেই সঙ্গে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকাটাই সংরক্ষণের মাপকাঠি হওয়া উচিত, এই বক্তব্য ন্যায্যতা পাচ্ছে। এর ফলে সমস্ত জাতই নিজেদেরকে অবহেলিত-উপেক্ষিত দেখিয়ে কে কার চেয়ে বেশি সংরক্ষণ পাবে সেই লড়াইয়ে মেতে উঠছে। এতে রাষ্ট্র দুই ধরনের সুবিধা পাচ্ছে। প্রথমত, জাতপাত নির্বিচারে দেশের জনগণের জন্মগত যে অধিকার এমনিতেই পাওয়ার কথা, সেখান থেকে সকলের দৃষ্টি সরে যাচ্ছে। জীবনের অধিকার ভারতবাসী মাত্রেই মৌলিক অধিকার একথা সংবিধানে বলা আছে। আর সংবিধানের স্পিরিট অনুসারে খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কাজ সমস্তটাই জীবনের অধিকারের মধ্যে পড়ে। অর্থাৎ এই সমস্ত কিছুও দেশের মানুষের অধিকার হিসাবে পরিগণিত হওয়ার কথা। ব্যাপারটাকেই বেমালুম চেপে যাওয়া হয়। দুই, যার আছে আর যাদের নেই, সেই চিরাচরিত লড়াইটাকে বিপথে ঘুরিয়ে দেওয়া যায়। যাদের শোষণ করা হচ্ছে অর্থনৈতিকভাবে, তাদেরকে বিভন্ন জাতের স্তরে পরস্পরের সঙ্গে সংরক্ষণের জন্য লড়িয়ে দিলে, যাদের আছে, তাদের বিরুদ্ধে লড়াইটা দুর্বল থেকে দুর্বলতর হবে। তাছাড়া যুগ যুগ ধরে যারা সামাজিক ঘৃণা আর বঞ্চনার শিকার, তাদেরকে বাকি অর্থনৈতিক শোষণের শিকার মানুষের চোখেও গণশত্রু বানিয়ে দেওয়া যাবে। আর বর্তমান আলোচ্য সিডিউলড কাস্টদের মধ্যে সাব-ক্যাটাগোরাইজেশন তো সব দিক থেকে যুগ যুগ বঞ্চনার শিকার দলিতদেরকেও টুকরো টুকরো করে ফেলবে। খেলার শেষে সেই জিতে যাবে ব্রাহ্মণ্যবাদী-পিতৃতান্ত্রিক-দেশ লুঠের দালাল রাষ্ট্র ব্যবস্থা। যার মাথায় বসে থেকে হাতে গোনা কিছু উঁচু জাত আর ধনকুবের কলকাঠি নাড়ছে।

যাই হোক, সুপ্রিম কোর্টের এই রায় নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনগুলির মধ্যে। সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের বিরোধিতা করছেন, মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি, চিরাগ পাসোয়ানের লোক জনশক্তি পার্টি, রাজকুমার রোয়াতের ভারত আদিবাসী পার্টি এবং চন্দ্রশেখর আজাদের আজাদ সমাজ পার্টি। তেলেঙ্গানা ও কর্ণাটক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা এই রায়কে সমর্থন জানিয়েছেন। কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী কংগ্রেসের। তেলুগু দেশম পার্টিও সমর্থন জানিয়েছেন। কংগ্রেস ও সমাজবাদী পার্টি অবশ্য কেন্দ্রীয় স্তরে এই সাব ক্লাসিফিকেশনের বিরোধিতা করেছে। এদিকে খোদ বিজেপি-ও সরকারিভাবে বলেছে, “বি.আর. আম্বেদকরের লেখা সংবিধান অনুসারে এসসি-এসটি সংরক্ষণের প্রশ্নে ক্রিমি লেয়ার নিয়ে কোনও প্রভিশন নেই।” অন্তত সংবিধান অনুসারে এর চেয়ে বেশি সত্যি আর কিছু হয় না। কারণ হিসাবে আবারও ফিরে আসে, সিডিউলড কাস্ট বা সিডিউলড ট্রাইব-দের সংরক্ষণের ভিত্তি যুগ যুগ ধরে এঁদেরকে সামাজিকভাবে যে বঞ্চনার শিকার হতে হয়েছে, সেই প্রশ্ন। এই প্রশ্নকে অস্বীকার করলে সবকিছু ঘুলিয়ে দেওয়া হয়।

আচ্ছা, তার মানে কী সিডিউলড কাস্ট বা দলিতরা একটা সমসত্ত্ব শ্রেণি। সকলেই অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে সমান অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছেন? না, একেবারেই তা নয়। প্রথম বা দ্বিতীয় প্রজন্ম যারা সংরক্ষণের সুবিধা পেয়েছেন, তাঁরা অর্থনৈতিক ভাবে অনেকটা এগিয়ে গেছেন। সামাজিকভাবেও লাভ করেছেন শিক্ষা ও সম্মান। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলিত জনতার চেয়ে তাঁরা জীবনযাপনের মানেও অনেক এগিয়ে। এই অবস্থানের ভালো ও খারাপ দুই দিকই আছে। ভালো দিকটা হলো, গোটা দেশ ও পৃথিবীর সম্পর্কে জানা বোঝার পরিমাণ এবং সেই নিরিখে নিজেদের অবস্থান বোঝার ক্ষমতা এই শ্রেণির দলিতদের মধ্যে এসেছে। জাতের বিনাশ ঘটাতে এবং দলিতদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এমন একটা শ্রেণির প্রয়োজনের কথা আম্বেদকর বারবার বলেছেন। এই শ্রেণি সেই ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করুক এমন কামনা ছিল আম্বেদকরের। কিন্তু খারাপ একটা দিকও যে রয়েছে। সেটা হলো জাতের বিনাশের জায়গায় জাতে ওঠার প্রক্রিয়া। ব্রাহ্মণ্যবাদ হাজার বছর ধরে এই মূলা ঝুলিয়ে রেখেছে। বিদ্রোহী হয়ে ওঠা নিপীড়িত মানুষের একটা অংশকে নিজেদের বশংবদ বানিয়ে নিপীড়িত মানুষদের উপর শোষণ অব্যাহত রাখার প্রক্রিয়া। দেশের আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো যদি প্রতি পদক্ষেপে বিভাজনভিত্তিক হয়, তাহলে কিছু দলিত মানুষ আমলা হতে পারেন সংরক্ষণের সুবিধায়, কিন্তু আমলা হয়ে তাঁদের সেই বিভাজনের দর্শনেরই সেবা করে যেতে হবে। ইচ্ছে থাক আর নাই থাক। নিজেদের উঁচুজাতের কাছে আরও বেশি বিশ্বস্ত দেখানোর প্রতিযোগিতায় দূরত্ব তৈরি হবে নিজের ঐতিহাসিক শোষিত অবস্থান ও জনগণের সঙ্গে। সেটা ঘটছেও। আর সেটা নিয়ে হতাশা ব্যক্তকারীদের মধ্যে একজন ছিলেন খোদ আম্বেদকর। কিন্তু তারপরও উচ্চ শ্রেণির দলিতদেরও তো হতে হয় সামাজিক বঞ্চনার শিকার। পদে পদে অপদস্থ হওয়ার মাত্রাটা কম হলেও থেকে যায় দুই তিন প্রজন্ম শিক্ষিত দলিতদের ক্ষেত্রেও। কিন্তু কড়া বাস্তব হলো সিডিউলড কাস্টদের মধ্যে দুই বা তিন প্রজন্ম সংরক্ষণের সুবিধা যারা পাচ্ছেন, তাদেরকে বাদ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে এই রায়ে, এমন কিন্তু নয়। বরং, দলিতদের মধ্যে বিভিন্ন জাতগুলোকে আলাদা আলাদা করে হিসেব নিকেশ করে কে কতটা এগিয়ে বা পিছিয়ে সেটা বিচার করবার কথা বলা হয়েছে। এটা তো সরাসরি জাতের ভিত্তিতে টুকরো করার মতো কথা হলো। ইংরেজদের ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসিকে সর্বোচ্চ আদালতের এই রায় যেন স্পষ্ট গ্রহণযোগ্যতা দিল।

আবারও মনে করতে হবে যে দলিতদের সংরক্ষণটা কিন্তু সামাজিক বঞ্চনার প্রশ্নে আসছে। যতদিন জাত ব্যবস্থা, ততদিন সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা। জাতব্যবস্থার সামাজিক বঞ্চনা না থাকলে সংরক্ষণের প্রয়োজন নেই। বিষয়টা এতোটাই সহজ। আর অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকার দায় সংরক্ষণের ঘাড়ে চাপিয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদী রাষ্ট্রকাঠামো নিজের মৌলিক কর্তব্য এড়িয়ে যেতে পারে না। সেটা একেবারেই আলাদা অ্যাজেন্ডা। সকল দেশবাসীর অ্যাজেন্ডা। সকলের মৌলিক অধিকারের প্রশ্ন।

সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান কিন্তু নির্ধারিত হচ্ছে ভারতের ব্রাহ্মণ্যবাদ ও জাত ব্যবস্থাকে নিয়ে প্রত্যেকের বোঝাপড়ার ভিত্তিতে। কিন্তু তারপরেও কয়েকটা কথা থেকে যায়। রায় যা দেওয়া হলো তো হলো, কিন্তু যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রায় দেওয়া হলো সেটা আরও বিপজ্জনক। কেন? সুপ্রিম কোর্টের এই রায়দানকারী বিচারকদের একজন হলেন বিচারপতি মিথাল। তিনি এই রায়টি দেওয়ার সময় যা বলেন, সেটা সরাসরি ইংরাজিতেই দিচ্ছি। যাতে ভুল বোঝবার অবকাশ না থাকে। বিচারপতি মিথাল বলেন, “to my limited understanding of the scriptures specially the Gita, I am of the firm view that in primitive India there was no existence of any caste system rather there was categorisation of the people according to their profession, talent, qualities and nature” and “the misconstruction of the varna system as a caste system was a social defect that crept in with time and was not considered to be good as it divided the society and brought about discrimination and inequality.”

উনি রায়দানের ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ্যবাদী গ্রন্থ গীতার ভাষ্যের উপর ভরসা করছেন। সেখান থেকে তাঁর উপলব্ধি যে প্রাচীন ভারতে জাত ব্যবস্থা ছিলই না। বরং ছিল বর্ণ ব্যবস্থা। মানুষের পেশা, প্রতিভা, গুণাবলী এবং চরিত্রের প্রকৃতির উপর দাঁড়িয়ে বর্ণ বিভাজন লাগু ছিল। উনি এগুলিকে মৌলিক ভিত্তি বলে দেখাচ্ছেন বর্ণ ব্যবস্থার, সেটা ভারতের ঐতিহাসিক আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের তথা ব্রাহ্মণ্যবাদের গোরার কথা। তাছাড়া ঐতিহাসিক পর্যবেক্ষণে বোঝা যায় জাত ব্যবস্থা ছিল রাষ্ট্রের আধিপত্যে বিভিন্ন জনজাতির মানুষকে অধীনস্থ করবার বাস্তব অনুশীলন। সেটাকে শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যায় জন্মগত বর্ণ কাঠামোর মধ্যে ধারণ করে ব্রাহ্মণরা একে চিরকালীন বলা প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন। সে আলোচনা বিস্তারে অন্যত্র করা যাবে। কিন্তু এখানে বিচারকের রায়দানের ভিত্তিটাই চরম বিপজ্জনক। সংবিধানের নয়, রাজনৈতিক হিন্দুত্বের ব্যাখ্যাই যেন শোনা যাচ্ছে।
তাছাড়া বিচারপতি গাভাই তাঁর রায়ে বলেন, রাজ্যগুলিকে অবশ্যই এসসিদের মধ্যেকার ক্রিমি লেয়ারকে চিহ্নিত করতে হবে, এবং তাঁদের সংরক্ষণের আওতা থেকে বাদ দিতে হবে। বিচারপতি বিক্রম নাথ গাভাইয়ের বক্তব্যে সম্মতি জানিয়েছেন। খেলাটা জম্পেশ। রাজ্যগুলির কাঁধে বন্দুক রেখে চালানো হবে এই বিভাজনের খেলা। রাষ্ট্রের কেন্দ্রীকরণের এবং কেন্দ্রকে অক্ষত রেখে যুক্তরাষ্ট্রের বাকি কাঠামোকে ভিতর থেকে ক্ষইয়ে ফেলে এক হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের দিকে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে যেন। খোলা বাজারের যুগে নয়া ব্রাহ্মণ্যবাদ বা রাজনৈতিক হিন্দুত্বের মূল লক্ষ্য কিন্তু সেদিকেই যাওয়া।

তথ্যসূত্রঃ—
1. Scroll. “Explained: Supreme Court Constitution bench verdict on sub-classification in SC/ST reservations”. Last modified August 02, 2024, 06:30 am.
https://scroll.in/article/1071536/explained-supreme-court-constitution-bench-verdict-on-sub-classification-in-sc-st-reservations
2. Scroll. “Sharp divide opens up on Supreme Court’s verdict on sub-classification of SCs and STs”. Last modified August 02, 2024, 04:30 pm.
https://scroll.in/article/1071572/sharp-divide-opens-up-on-supreme-courts-verdict-on-sub-classification-of-scs-and-sts
3. Teltumbde, Anand. “Sub-categorisation verdict helps BJP’s agenda and endangers Dalit future.” Scroll, August 18, 2024. https://scroll.in/article/1072138/sub-categorisation-verdict-helps-bjps-agenda-and-endangers-dalit-future
4. Raveendran, Rehnamol. “Sub-Categorisation Debate: Unanswered Questions.” The Wire, 19 August, 2024. https://thewire.in/caste/sub-categorisation-debate-unanswered-questions

1 Comment

  1. Hajra Gargi says:

    লেখা টি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। ভালো লাগলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *