বহ্নিহোত্রী হাজরা
ভারত নামের দেশটা কি সত্যিই একটা জাতির দেশ, নাকি বহু জাতিসত্তার কারাগার? প্রশ্নটা কিন্তু রয়েছে সেই জন্মলগ্ন থেকেই। ৪৭-এর মধ্যরাতের হাত বদলের ঠিক পরেই প্রথম যিনি গ্রেপ্তার হন ‘এ আজাদী ঝুঠা হ্যাঁয়’ বলে, তাঁর নাম ই ভি রামাসামী পেরিয়ার। তিনি প্রশ্ন করেন- “এ কার ভারত? কার স্বাধীনতা? ভারত কি কোনও একটি দেশ? আমাদের যা আছে তা শুধুমাত্র বহু ভাষা, জাতি ও ধর্মের সংগ্রহ।” রুশ লেখক এ এম ডায়াকভ ভারত সম্পর্কে বলেছিলেন- ভারতের বিভিন্ন এলাকার সংস্কৃতির মধ্যে যতটুকু মিল আছে তা ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মধ্যে যা তার থেকে বেশি তো নয়ই, বরং একজন ফরাসী এবং একজন ব্রিটিশের যতটা সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান বা যোগসূত্র থাকে তার চেয়ে একজন পাঞ্জাবি এবং ওড়িয়ার মধ্যেকার যোগসূত্র অনেক অনেক কম। ফলে গোঁজামিল দিয়ে যারাই ভারতকে এক জাতির রাষ্ট্র বানাতে গেছেন, তাঁরা ‘হিন্দুত্ব’-কেই প্রকারান্তে ঐক্যের মাপকাঠি বলে ধরে নিয়েছেন। আর সেখান থেকেই অনেকগুলি সংকটের সূত্রপাত হয়েছে, যার জেরে আমরা আজ ক্ষতবিক্ষত। আজকে কে ভারতের নাগরিক সেই প্রশ্ন তুলে কার্যত দেশের মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছে এই রাষ্ট্র। এখন তো এই দাঁত-নখ বার করা চেহারা আমরা দেখছি হালের ব্রাহ্মণ্যবাদী ফ্যাসিস্তদের শাসনকালে, কিন্তু ৪৭-এর ১৫ আগস্টের পর থেকেই কেন্দ্রের শাসকদের ‘লৌহপুরুষ’ ইমেজের আড়ালে কিন্তু ছিল ভয়, টুকরো টুকরো হয়ে যাবার ভয়। আর তা থাকবে নাই বা কেন? বাংলা, পাঞ্জাব, কাশ্মীর থেকে উত্তর-পূর্ব ভারত যেভাবে সেইসব জাতির মানুষের মতামতের তোয়াক্কা না করে, এক তরফা দখলদারী চালিয়ে গেছেন নেহেরু-প্যাটেল জুটি, তাতে এই ভয় সুপ্ত থাকাটাই তো স্বাভাবিক।
মজার ব্যাপার হলো যখন ১৯৪৮ সালে ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠন হচ্ছে তখনও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে বিচ্ছিন্নতাবাদী দেগে দেওয়ার প্রবণতা এবং ভয়। প্রদেশ গঠনের কমিশন বলছে, ভারত এখনো জাতি গড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় রয়েছে, কিন্তু এর মধ্যে অনেকগুলি জাতিসত্তা রয়েছে, যাদের মধ্যে রয়েছে মুক্ত হবার আকাঙ্ক্ষা। অর্থাৎ মায়ের জন্ম হবার আগেই তার বেশ কিছু পরিণত সন্তান রয়েছে। কি অবাক কান্ড! এই জাতি গড়ে ওঠার তেমন কোনও ভিত্তি নেই, ভাষাগত, সাংস্কৃতিক কোনও ঐক্যের শিকড় নেই, কিন্তু চাপিয়ে দেওয়া হল হিন্দুত্ব এবং হিন্দি ভাষাকে। হিন্দি ভাষাকে অফিসিয়াল বা সরকারি ভাষা হিসেবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করা হয়েছে সংবিধানেই। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত প্রথম থেকেই চরম বিতর্কিত। আম্বেদকর নিজে বলেন, ভাষার প্রশ্নে যে আর্টিকেল ১১৫ ছিল, সেটা ছিল সবচেয়ে বিতর্কিত ধারা। দক্ষিণ ভারতের সোচ্চার প্রতিবাদ সেদিনও ছিল। তামিলনাড়ুর টি এ রামালিঙ্গম বলেন, “এ আমাদের জীবন-মরণের প্রশ্ন।” তাঁদের আন্দোলনের চাপে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে হিন্দি কখনোই পাশ হয় না। বাংলা, হিন্দি সহ ২২টি অষ্টম তফশিলভুক্ত ভাষা রয়েছে, যার প্রত্যেকটিই রাষ্ট্র ভাষা হওয়ার দাবিদার। তারপরেও আজ অমিত মালব্যরা এ কথা বলার ধৃষ্টতা দেখান যে, বাংলা বলে কোনও ভাষা নেই। বাংলাদেশি ভাষা বলে দাগিয়ে দিয়ে লেখা হয় সরকারি চিঠি। আর অদ্ভুত ব্যাপার বাংলার শ্রমিক সামিম খান, দেবাশীস দাসরা যখন মাতৃভাষায় কথা বলার জন্য অত্যাচারিত হচ্ছেন, তখন দাঁড়িপাল্লা হাতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন এসব বাংলা ভাষার ওপর কোনও আক্রমণই নয়। অর্থাৎ আমলা বা সুটেড-বুটেড বাবুরা আক্রমণের মুখে না পড়লে আগুনের আঁচ তাদের গায়ে লাগে না। অথচ বাস্তব হলো আজ ভাষার প্রশ্ন, জাতিসত্তার প্রশ্ন বাস্তবে বাংলার আপামর নিম্নবর্গের শ্রমজীবী দলিত-মুসলমান এবং জনজাতির মানুষেরই প্রতিনিধিত্ব করার দাবি রাখে। সেই চর্যাপদের কাল থেকেই বাংলার সংস্কৃতি বা ভাষা গড়ে উঠেছে কিন্তু এই নিম্নবর্গের হাত ধরেই, যে স্রোতকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন লালন বা নজরুলের মতো মানুষরাই। আজ ভাষার অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ করতে তাঁদের কাছে আমাদের ফিরতেই হবে। তবে কেন্দ্রের এই দখলদারী শুধু ভাষার প্রশ্নে নয়, ফেডারেল কাঠামো আজ সমস্ত দিক থেকেই ভেঙে পড়েছে। রাজ্য-কেন্দ্র সম্পর্ক কেমন অধীনতামূলক মিত্রতা নীতির মতো অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। একসময় আনন্দপুর সাহিব রেজোলিউশনে দাবি উঠেছিল প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক বিভাগ, মুদ্রা এবং যোগাযোগ বাদে আইন প্রণয়ন, অর্থসহ সমস্ত ক্ষমতা থাকবে রাজ্যের হাতে। সে লক্ষ্যে পৌঁছনো তো আজ দুরাশা বরং কঙ্কারেন্ট লিস্টে থাকা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইনশৃঙ্খলা থেকে শুরু করে প্রতিটা বিষয়ে নাক গলাচ্ছে কেন্দ্র। NEP-এর মতো আইন প্রণয়ন করে ত্রিভাষা নীতির নামে হিন্দি চাপিয়ে দিচ্ছে সর্বত্র। আইনি পরিবর্তন করা হচ্ছে যাতে নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীকে খারিজ করার এক্তিয়ার পান রাজ্যপাল। অর্থাৎ আজ রাজ্যকে কার্যত মিউনিসিপালিটির স্তরে নামিয়ে এনেছে এই হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থানের ঠিকেদাররা। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে অনেক প্রগতিশীল বা তথাকথিত বামেরা ভুলে গেছেন সেই ফেডারেলিজমের দাবিদাওয়াগুলোর কথা। তাঁদের জন্য মনে করিয়ে দিই অমলেন্দু সেনগুপ্তের সাথে আলাপচারিতায় সোমনাথ লাহিড়ীর এক সময়ের বক্তব্য। “লেনিনের National Question-কে আমরা বুঝিনি। Right of self determination up to the point of succession যদি মেনে নেওয়া যায়―তবেই হবে এই সমস্যার সমাধান। ইংরেজ আমলে গায়ের জোরে ইংরেজরা এক ধরনের কৃত্রিম শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল―আর ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে এক ধরনের কৃত্রিম ঐক্য সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু বহুজাতিক দেশ With uneven development―এই ঐক্য টিকবে কীকরে? যদি Maximum power to the States আর Minimum power to the centre এই ফর্মুলায় দেশ চলতো―তাহলে এসব ঘটতো না।“
বাংলার কথা বলতে গেলে ঘুরে ফিরে আসবেই কাঁটাতারের ক্ষতের দাগ। ছিন্নমূল হয়ে ওপার থেকে এপারে আসা এবং এপার থেকে ওপারে যাওয়ার স্রোত। শুধু ৪৭-এই নয়, এর পর থেকে বিভিন্ন সময়ে ধাপে ধাপে মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে। ওপার থেকে এপারে এসেছে কোটি কোটি মানুষ। আবার এপারের মুসলিম সম্প্রদায়ের এক বড়ো অংশও কিন্তু উদ্বাস্তু হয়ে ওপারে গেছে। ৪৭-এ আসা মানুষের মধ্যে সম্ভ্রান্ত ঘরের বর্ণহিন্দুদের সংখ্যা ছিল বেশি। তবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৫০-এর দাঙ্গার পর বিশাল সংখ্যক নিম্নবর্গের হিন্দু বিশেষত নমশূদ্র সপ্রদায়ের মানুষ এদেশে আসে, যাদের অবস্থা ছিল আরও শোচনীয়। আবার সেই দাঙ্গার পরিস্থিতি এপারের কিন্তু ছিল। ফলে সেই সময় প্রায় ৭ লক্ষ মুসলমান মানুষ এপার থেকে ওপারে যান। এই সংখ্যাটার কথা কিন্তু অনেকেই বলেন না। সত্যি কথা বলতে বছরের পর বছর ধরে নিম্নবর্গের মানুষই আসলে বলি হয়েছে এই কাঁটাতারের যন্ত্রণার। এদের না ছিল ব্যক্তিগত পুঁজি, না আশ্রয়, না সামাজিক ক্ষমতা বা নিরাপত্তার কোনও উৎস। সমস্ত উদ্বাস্তুদের ক্ষেত্রে যে সরকারের ব্যবহার সমান ছিল তাও নয়। সেখানেও ছিল বৈষম্য। তাঁদের এই যন্ত্রণার আর্তনাদ দণ্ডকারণ্যের কলোনি থেকে সুন্দরবনের মরিচঝাঁপিতে গিয়ে মিশেছে। পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী সরকারও তাঁদের স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার দম্ভকে সহ্য করেনি তাই তাঁদের ঠাঁই সুন্দরবনের ব্যাঘ্র প্রকল্পের জমিতে বা খালের জলে কুমিরের পেটে হয়েছে। সরকারি পরিভাষায় তারা আজও নিখোঁজ। নেহেরু-লিয়াকত চুক্তিতে এবং ৪৭-এর পর থেকেই প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছিল ভারত সরকার, যে অবিভক্ত ভারতের সকল সন্তান খণ্ডিত ভারতের নাগরিক হিসেবে বিবেচ্য হবেন। কিন্তু এই প্রতিশ্রুতি বারে বারে লঙ্ঘিত হয়। আবারও আরেক মিথ্যা বচনে বুক বাঁধেন ছিন্নমূল মানুষ। এর আগে আমরা দেখেছি একদিকে ২০০৩ সালের আইন মোতাবেক লক্ষ লক্ষ ছিন্নমূল হওয়া মানুষকে ওরা অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর লেবেল সেঁটে দিল, বিপদে পড়লেন তাঁরা। পথে নামলেন। যদিও কার্যত এই আইনের কবলে পড়ে বিপদে রয়েছেন আরো লক্ষ লক্ষ মুসলমান এবং জনজাতির মানুষ, উচ্ছেদের শিকার হওয়া, বন্যা কবলিত হাজার হাজার মানুষ, যাঁদের কারো কাছেই কোনও নথি নেই। ২০১৯-এর পর আসামের ঘটনার অভিঘাতে কিন্তু এই ছিন্নমূল মানুষগুলোর সামনে ২০১৯-এ সিএএ-র মিথ্যা প্রতিশ্রুতি এবং আজ, ‘২০২৪-এ এপারে আসলেও তোমাদের বসবাসের অধিকার দেওয়া হবে’ বলে আবারও টোপ দিল এই ফেকুজির সরকার। বারে বারে অনিশ্চয়তা আর আতঙ্কে রাখার কল ওরা ভালোই ফেঁদেছে। এর পরে ২০২৯-এ লোকসভা নির্বাচনে আসতে চলেছে ডিলিমিটেশন। যার অর্থ কিন্তু জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসন পুনর্বিন্যাস। গোবলয় এবং অন্যান্য অঞ্চলের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার তুলনা করলেই বোঝা যাবে এ নিয়ে মোদী-যোগীর মনে কেন লাড্ডূ ফুটছে। গোবলয়ের সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রশ্নাতীত হবে এই ডিলিমিটেশন হলে। তবে তার আগে মুসলমান এবং নিম্নবর্গের মানুষকে ছাঁটাই করার ধূর্ত এই চক্রান্ত ওদের হাতে অসীম ক্ষমতা দেবে। দক্ষিণ, বাংলা বা উত্তর-পূর্বের আর কোনও ভাষ্যই গ্রাহ্য হবে না, বুলডোজার রাজ বিনা বাধায় এগোবে। তাই আবারও প্রশ্ন করুন এই কাঁটাতারকে। আর প্রশ্ন করুন কার স্বার্থে এসব হচ্ছে, আস্তিনের তলায় কোন এজেন্ডা রয়েছে এদের। আপনারা অনেকেই হয়ত বুঝছেন বেনাগরিক করার পিছনে আদানী-আম্বানীর মতো কর্পোরেটদের কাছে সস্তা শ্রমের মজুত বাহিনী গড়ে তোলাই আসল উদ্দেশ্য। কিন্তু এর সাথে আমাদের মেলানো দরকার বিশ্বজোড়া দেওয়াল তোলা এবং উদবাস্তুকরণের রাজনীতি- অর্থনীতিকে। বেশ বড় অংশের মানুষকে উদ্বৃত্ত বা ‘useless’ হিসেবে দেগে দেওয়ার একটা খেলা শুরু হয়েছিল সেই প্ল্যান্ডেমিকের সময়। বিশ্বকে যারা চালায় সেই কর্পোরেট চাঁইদের অন্যতম পান্ডা ক্লাউস শোয়াবের এই ছিল মূল ভাষ্য। আর এই উপমহাদেশ তথা বাংলায় তো সেই ৭৯ বছর আগেও লক্ষ লক্ষ নিম্ন বর্গের মানুষকে ভিটেছাড়া করে তাঁদের বুকের ওপর ক্ষতচিহ্ন এঁকে দেওয়ার কারীগর বিড়লা, পুরুষোত্তমের মতো সেযুগের শক্তিশালী দালাল কর্পোরেট আর প্যাটেল-নেহেরু-শ্যামাপ্রসাদের মতো বাবু নেতারা আজ আবারও বাংলাকে ‘শত্রু’ হিসেবে দেগে, প্রশ্ন চিহ্নের মুখে ফেলে তাঁদের পে লোডারে করে ছুঁড়ে ফেলছে ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকগোষ্ঠী ওই কর্পোরেটদেরই স্বার্থসিদ্ধি করতেই। আজ আমরা এটুকু বুঝতে পারছি আমরা বসে আছি একটা আগ্নেয়গিরির ওপর। যে কোনও দিন বিস্ফোরণ হতে পারে তারই অপেক্ষায়। আবারও স্বাধীনতার লড়াইয়ের মুখে দাঁড়িয়ে বাংলার আপামর মানুষ এবং বিশেষত বাংলার দলিত, মুসলমান এবং আদিবাসী খেটে খাওয়া মানুষ।
তথ্যসূত্রঃ
১। ঘোষ সুনীতি কুমার, বাংলা বিভাজনের রাজনীতি অর্থনীতি, কোলকাতাঃ২০০১
২। Ghosh Suniti Kumar, Nationality Problem and Indian Ruling Classes, Kolkata:1996
৩। বাংলা জাতিসত্তা খন্ড-অখন্ড-অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ, দশদিশি, অক্টোবর ২০১৯-মার্চ ২০২০
৪। চ্যাটারজি হিমাদ্রী, সেনগুপ্ত অন্বেষা, “এই বাংলার উদ্বাস্তু”, কোলকাতাঃ ২০১৯
ছবি- শিল্পী পার্থ চক্রবর্তী

