প্রথম নগরবিপ্লব: হরপ্পা

রক্তিম ঘোষ

হরপ্পা সভ্যতা নিয়ে কথা বলবার আগে কয়েকটা বিষয় বলে নেওয়া ভালো। বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ। হরপ্পা সভ্যতার নগর বিন্যাস নিয়ে জানবার জন্য অসংখ্য ভালো বই রয়েছে বাংলাতে। এখানে কিন্তু সেসব খুঁটিনাটি নিয়ে চর্চা করিনি। এখানে মূলত এই নগরসভ্যতার বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যের দিকে নজর দিতে চাওয়া হয়েছে। আমাদের মূল উদ্দেশ্য হলো ভারতীয় সভ্যতার মুখ্যধারাকে খুঁজে নেওয়া, সে কথা মাথায় রেখেই নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে নজর দেওয়া হয়েছে। আরও জানবার জন্য বই পড়ুন তবে, কয়েকটা বিষয় মাথায় রেখে। হরপ্পা সভ্যতার লিপি এখনও পাঠোদ্ধার করা যায়নি। হ্যাঁ, অনেকেই এমন দাবি করছেন বটে, তবে সেগুলো খুব যে স্বীকৃতি পেয়েছে এমন নয়। তাছাড়া যারা এই ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ বা কাজ করছেন তাঁরা নিজেরাও সেভাবে ঐক্যমত নন।  হরপ্পার লিপি পাঠের দাবির রাজনীতি বেশ তীব্র। এখন সেসব আমাদের চিন্তার বিষয় নয়। বরং লিপির পাঠোদ্ধার হয়নি ধরে নিয়েই আমরা চলবো। কিন্তু হরপ্পা নিয়ে আমাদের সকলেরই জানার সূত্র তাহলে কী? অবশ্যই মাটি খুঁড়ে প্রতন্তাত্ত্বিকরা হরপ্পা সভ্যতার যে কেন্দ্রগুলি উদ্ধার করেছেন এবং সেখান থেকে পাওয়া নানা তথ্য নিয়ে ঐতিহাসিক গবেষকরা যে বিশ্লেষণ করেছেন সেটুকুই। সবার আগে হরপ্পা সভ্যতার বিস্তারের খবর দিই। যতো বড়ো এলাকা জুড়ে হরপ্পা সভ্যতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ক্ষেত্র প্রত্নতত্ত্ববিদেরা সন্ধান করতে পেরেছেন, আয়তনে তা বর্তমান পাকিস্তান রাষ্ট্রের চাইতেও বড়ো। বর্তমানে এমন সাইটের সংখ্যা ১০২২ টি। ৬১৬ টা ভারতে অবস্থিত আর ৪০৬টা পাকিস্তানে। তবে তথ্যের উৎস কিন্তু আরও সীমিত। মাত্র ৯৭টা সাইট খোঁড়া হয়েছে এখনও পর্যন্ত। সুতরাং হরপ্পা সভ্যতার সম্বন্ধে খুব সামান্যই আমাদের জানবার অবকাশ রয়েছে বাস্তবে। তথ্য কম। তবে হ্যাঁ, জানবার সুযোগ রয়েছে অনেক বেশি। ১০২২টি সাইটের মধ্যে মাত্র ৯৭ টির তথ্য পাচ্ছি, বাকি প্রায় আরও হাজার। আরও একটা বিষয় এর থেকে বলা যায়, শুধুমাত্র লিপির পাঠোদ্ধার হচ্ছে না বলে হরপ্পা সম্পর্কে তথ্য অপ্রতুল, বিষয়টা সত্যি নয়। জানবার অবকাশ আরও নানা দিক থেকে রয়েছে।

সবার আগে আর একটা বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার। সেটা হলো হরপ্পার সময়কাল। হাজার মাতব্বর হাজার স্বার্থে এই সময়কাল নিয়ে নানান অতিকথা নির্মাণ করছে। আর হোয়াটস অ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যাণে মানুষের মনেও ভুলভাল ধারণা গেঁথে যাচ্ছে। সময় নিয়ে তো বটেই আর তার অনুসঙ্গে নানা কল্পকাহিনী। সময়কালটা সঠিকভাবে অনুমান করতে পারলে কিন্তু অনেক মিথ্যা আর উদ্দেশ্য প্রণোদিত অপপ্রচারের মোকাবিলা করতে খানিক সুবিধা হয়। মনের ধোঁয়াশাও কাটে খানিক। তো বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক রেডিও কার্বন টেকনোলজি ব্যবহার করে জানতে পারা যাচ্ছে, আদি হরপ্পা সভ্যতার সময়কাল ৩২০০-২৬০০ সাধারণ পূর্বাব্দ; পরিণত হরপ্পা সভ্যতার সময়কাল ২৬০০-১৯০০ সাধারণ পূর্বাব্দ; এবং পরবর্তী হরপ্পা সভ্যতার সময়কাল ১৯০০-১৩০০ সাধারণ পূর্বাব্দ। আদি হরপ্পা সভ্যতা কী? যখন ধাপে ধাপে হরপ্পা সভ্যতা গড়ে উঠছে, নগরায়ণ হচ্ছে, নাগরিক জীবনের নানা চিহ্ন ক্রমশ প্রকাশ পাচ্ছে। আর পরিণত হরপ্পা সভ্যতার মানে সেই যুগের নাগরিক সভ্যতা পরিপূর্ণতা অর্জন করেছে। সভ্যতা তার সর্বোচ্চ চেহারায় পৌঁছেছে। পরবর্তী হরপ্পা সভ্যতা হলো সভ্যতার অবনমনের সময়। ধীরে ধীরে সভ্যতার পতনের চিহ্ন তীব্র হচ্ছে। অবশেষে ত্রয়োদশ সাধারণ পূর্বাব্দে এসে হরপ্পা সভ্যতার শেষ চিহ্নটুকুর অবলুপ্তি ঘটছে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, এখানে উত্থান বা পতন কিন্তু হচ্ছে একটা নির্দিষ্ট ধরনের জীবনচর্যার-সংস্কৃতির-রাষ্ট্রব্যবস্থার-নাগরিক পরিকাঠামোর। এমন নয় যে এর আগে কিছু ছিল না পরে কিছু নেই।  অতীতের গর্ভেই জন্ম এবং ভবিষ্যতের প্রবাহে মিশে আছে হরপ্পা সভ্যতার নানান দিক। সে প্রসঙ্গে সময় মতন আসবো।

আর একটা তথ্য দিই, হরপ্পা সভ্যতা বলতে একটা জনপ্রিয় ধারণা আছে যে, বড়ো শহর ছিল মাত্র দুটো। হরপ্পা আর মহেঞ্জোদারো। বর্তমানে জানা যাচ্ছে যে, চোলিস্তানের লুরেওয়ালা আর গনেরিওয়ালা, হরিয়ানার রাখিগর্হি আর গুজরাতের ধোলবিরা, এই জায়গাগুলি হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদারোর মতন শহরের সমান ছিল অথবা তাদের চেয়ে আকারে বড়ো ছিল।

এবার আসা যাক এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে। হরপ্পা সভ্যতার জিন আমাদের কী খবর দিচ্ছে?

হরপ্পা সভ্যতার আশেপাশের কিছু এলাকার দেহাবশেষের জেনেটিক প্রোফাইল বিশ্লেষণ করা হয়েছে। জায়গা দুটি। শাহর-ই-শোকতা ও ব্যাকট্রিয়া-মার্জিয়ানা আর্কিওলজিকাল কমপ্লেক্স। এদের মধ্যে আন্দামানী শিকারী-সংগ্রাহক সম্পর্কিত জেনেটিক প্রোফাইল যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া গেছে। এই আন্দামানী  শিকারী-সংগ্রাহক কারা? এরা সেই প্রাচীন মানুষ, যারা সবার প্রথমে ভারতে এসেছিল একদিন আফ্রিকা থেকে পরিযান করে। ২ টো ফসিলের ডিএনএ বিশ্লেষণ করে পাওয়া গেছে H1a1d2 হ্যাপ্লোগ্রুপ। বর্তমান দক্ষিণ ভারতে এই হ্যাপ্লোগ্রুপ বেশি পরিমাণে দেখা যায়। তবে এই হ্যাপ্লোগ্রুপ প্রাচীন আন্দামানী শিকারী-সংগ্রাহকদের থেকে আসেনি। অন্য জায়গা থেকে এসেছে। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের ওঙ্গে আর জারোয়া পুরুষদের মধ্যে শুধু ওয়াই-ক্রোমোজোম ডি হ্যাপ্লোগ্রুপ পাওয়া যায়। এই হ্যাপ্লোগ্রুপ-এর ভিত্তিতে প্রাচীন ইরান থেকে আসা এক জনগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এরা এদেশে অনেক পরে এসেছে। তুষার যুগে। এদের বলা হচ্ছে ‘প্রাচীন ইরান সম্পর্কিত জনগোষ্ঠী’।

সে না হয় হলো, কিন্তু এই হ্যাপ্লোগ্রুপ ব্যাপারটা কী? মানুষের জিনের মধ্যে থাকে ডিএনএ। হ্যাপ্লোগ্রুপ হলো এক ধরনের ডিএনএ শৃঙ্খল। জিনগত মিউটেশন বা পরিব্যক্তি হয়ে এইসব শৃংখলে কী কী পরিবর্তন হয়েছে, তা জানা যেতে পারে। বাস্তবে পরিব্যক্তি বা মিউটেশন অত্যন্ত ধীর গতিতে হয়। খুব ধীরে হলেও প্রায় একটা নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর ডিএনএ শৃংখলে একটা পরিবর্তন ঘটে। সেখান থেকে ঠিক কত প্রজন্ম আগে সেই হ্যাপ্লোগ্রুপের সূচনা হয়েছে সেটাও মোটামুটি বলে দেওয়া যায়। প্রজন্মের গড় আয়ু হিসাব করে এটা করা যেতে পারে। পৃথিবীর যেকোনও প্রান্তের মানুষ নিজেদের মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ বিশ্লেষণ করে শেষ পর্যন্ত একটাই হ্যাপ্লোগ্রুপে গিয়ে পৌঁছয়। মাতৃক্রমের সমস্ত পরিব্যক্তি ধরে। ঠিক একইভাবে জগতের যেকোনও পুরুষের ওয়াই ক্রোমোজোমের সমস্ত পরিব্যক্তি ধরে পিছনে যেতে থাকলে শেষপর্যন্ত সমস্তটাই একটা নির্দিষ্ট হ্যাপ্লোগ্রুপে গিয়ে পৌঁছয়। তাই আধুনিক জিনবিজ্ঞানে বংশতালিকা তৈরি হয় মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ কিংবা ওয়াই ক্রোমোজোমের হ্যাপ্লোগ্রুপের ভিত্তিতে।

এবার আসবো হরপ্পা সভ্যতার অন্যতম নগর রাখিগর্হি-র কথায়। এখানে ৪,০০০ বছর আগের এক নারী ফসিলের ডিএনএ বিশ্লেষণ করা গেছে। অটোজোমাল ডিএনএ বিশ্লেষণ করে তথ্য পাওয়া যায় যে, প্রায় ১২,০০০ বছর আগে ‘প্রাচীন ইরান সম্পর্কিত জনগোষ্ঠী’ পূর্বদিকে পরিযান শুরু করেছিল। এরা ছিল শিকারী-সংগ্রাহক। তাই ‘প্রাচীন ইরান সম্পর্কিত জনগোষ্ঠী’-কে বলা যেতে পারে, ‘প্রাচীন ইরান-সম্পর্কিত শিকারী-সংগ্রাহক’। রাখিগর্হির এই নারীর দেহে কোনও ইন্দো-ইউরোপীয় জিন বা বৈদিক আর্য জিনের কোনও সন্ধান কিন্তু পাওয়া যায়নি।

মোটামুটিভাবে জিনের ভিত্তিতে যতটা তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে তাতে বোঝা যায় আফ্রিকা থেকে আসা প্রথম ভারতীয় শিকারী-সংগ্রাহকদের সঙ্গে অনেক পরে তুষার যুগে আসা প্রাচীন ইরান-সম্পর্কিত শিকারী-সংগ্রাহকদের মিলনের ফসল আমাদের হরপ্পা সভ্যতার বাসিন্দারা। তাঁদের সঙ্গে বৈদিক আর্যদের কোনও রকম সংমিশ্রণ হয়নি।

এবার দেখবো জিনগতভাবে হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীরা বর্তমান যুগের আমাদের উপর কতোটা ছাপ রেখেছেন। এই প্রসঙ্গে মধুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, “সামগ্রিকভাবে ভারতীয়দের পূর্বজদের সম্পর্কে বিশদ ধারণা অর্জন করতে ডেভিড রাইখ ও তার সহকর্মীরা আজকের দক্ষিণ এশিয়ার (মূলতঃ ভারত) ২৪৬টি স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠীর থেকে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করেন। প্রারম্ভিক হলোসিন ইরানীয়দের মধ্যে প্রাপ্ত জেনেটিক প্রোফাইল আধুনিক দক্ষিণ এশিয়দের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে পাওয়া যায়। এই তথ্য ওই সময়ে ইরান থেকে দক্ষিণ এশিয়াতে মাইগ্রেশনের সম্ভাবনাকে স্পষ্ট করে। দক্ষিণ এশিয়দের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ডিএনএ এবং জিনোমিক তথ্যগুলি বিশ্লেষণ করে ওরা সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, ‘সিন্ধু নদের সীমান্তবর্তী জনগোষ্ঠী’র মানুষ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী গঠনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে।

হরপ্পীয় সভ্যতার ক্ষয়ের সময়ে, তিন হাজার নয়শ থেকে তিন হাজার বছর আগে, এই জনগোষ্ঠীর মানুষ ক্রমাগত দক্ষিণ এশিয়ার দক্ষিণ ও পূর্ব দিকে চলে যায়। এরা যত দক্ষিণ দিকে যায় ততো বেশি করে আন্দামানী শিকারী-সংগ্রাহকদের সঙ্গে মিশ্রিত হতে থাকে। এই মিশ্রণের ফলে তৈরি জনগোষ্ঠীকে বলে ‘প্রাচীন দক্ষিণ ভারতের মিশ্র জাতি’, বা ‘Ancestral South Indians’। ওই সময়ে উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে দক্ষিণ-পূর্ব ভারতে জনগোষ্ঠীর মিশ্রণে এক নতিমাত্রা বা ‘গ্রেডিয়েন্ট’ তৈরি হয়।

এই নতির একদিকে আছে আন্দামানী শিকারী-সংগ্রাহকরা। দক্ষিণ আন্দামান অঞ্চলের আদিবাসীদের মধ্যে এই মিশ্রণ হয়েছে সবচাইতে কম। ধরা যেতে পারে ওরা যেন প্রায় অবিমিশ্র প্রাচীন ভারতের শিকারী-সংগ্রাহক।

নতির অন্য প্রান্তে আছে ‘প্রাচীন ইরান সম্পর্কিত জনগোষ্ঠী’। আর নতির মাঝে এক জায়গায় আছে হরপ্পীয়রা।”

সার কথা অতি সহজে বলেছেন। এর আর কোনও বিশ্লেষণ প্রয়োজন নেই বলে মনে হয়। তবে এখানে থাকবে বিধিবদ্ধ সতর্ককরণ। আমরা সকলেই জিনগত উৎসে আফ্রিকার থেকে মহাপরিযানে আসা আধুনিক মানুষের সন্তান। জিনবিদ স্পেন্সর ওয়েলসের মতে, আমরা সকলেই সকলের আত্মীয়। মহাপরিযান দল থেকেই আমাদের সকলের উদ্ভব। হ্যাঁ মাঝখানে ২০০০ প্রজন্মের ব্যবধান রয়েছে। অতএব জিনভিত্তিক কোনও ধরনের রেসিয়াল তত্ত্ব বা রক্তের বিশুদ্ধতার তত্ত্ব সম্পূর্ণ কাল্পনিক। গর্বিত বিশুদ্ধ আর্য রক্তর ধারণা এবং তার প্রতিক্রিয়ায় মূলনিবাসী তত্ত্ব, দুইই কার্যত অনৈতিহাসিক-কাল্পনিক এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। ভারতের সমাজে ঐতিহাসিকভাবে বৈদিক-আর্য ভাষাগোষ্ঠীর ধারার সঙ্গে প্রাক্‌-বৈদিক মানুষের সংঘাত নানা মাত্রায় দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু জিনগত কারণে এখানে ফারাক খুঁজলে ভুল হবে। পার্থক্য বরং সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক-ভাষাগত এবং নানা স্তরের। এখন বিশদে যাচ্ছি না, বরং ডিএনএ-জিন ইত্যাদির জটিলতা থেকে বেরিয়ে এবার উপমহাদেশের প্রাচীনতম নগরগুলোর দিকে তাকাই। কেমন এক অতিকথা ভাঙার মেজাজে চলে গেছি আমরা। আসুন সেই ধারাবাহিকতায় আর এক মিথ ভাঙা যাক। ছোটোবেলা থেকে পাঠ্যবইতে পড়ে আসছি হরপ্পা সভ্যতায় লোহার ব্যবহার ছিল না। তাম্র-ব্রোঞ্জ সভ্যতা ছিল হরপ্পার। বৈদিক আর্যদের বিশেষত্ব হিসাবে আসতো লোহা ব্যবহারের অনুসঙ্গ। গুজরাতের লোথাল হরপ্পা সভ্যতার অংশ তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। মনে করেন অনেকে যে এ ছিল সভ্যতার অন্যতম সমুদ্রবন্দর। সেখানে এমন দুটো ধাতুর জিনিস পাওয়া গেছে, যেগুলোর মধ্যে কিছুটা লোহার অস্তিত্ব রয়েছে। একটায় ৩৯.১ শতাংশ অপরটায় ৬৬.১ শতাংশ। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে উপিন্দর সিং মনে করছেন, অন্তত গুজরাত এলাকায় লোকেরা লোহা গলাতে জানতো। কিন্তু এমনও তো হতে পারে এসব বাইরে থেকে আসা। যদি লোথাল সমুদ্র বন্দর হয় সেক্ষেত্রে এসব বাইরে থেকে এসে থাকতেই পারে। স্থানীয় মানুষ লোহা গলিয়েই এসব মিশ্র ধাতু বানিয়েছেন এমন সম্ভাবনা থাকলেও, তার ভিত্তিতে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। তবে সভ্যতায় ধাতু খুব দামী ছিল বা ধাতুকে বেশ দামী বলে ভাবা হতো এমন ধারণা করবার অবকাশ রয়েছে। যেমন, হরপ্পায় এক গুপ্ত ভাণ্ডার পাওয়া গেছে। একটা ব্রোঞ্জের প্রলেপ দেওয়া পাত্র মাটির নিচে লুকিয়ে রাখা অবস্থায় পাওয়া গেছে। সেখানে বিভিন্ন ধরনের তামার সামগ্রী রাখা ছিল। কুঠার, ছুরি, বর্শাফলক, তীরের ফলা, চিজেল, আর একটা পাত্র। পাথরের ব্যবহারই ছিল সাধারণ।

তবে সমগ্র হরপ্পা সভ্যতার যে বিশাল ব্যাপ্তি আমরা দেখলাম একটু আগে, সেখানে সংস্কৃতিতে, ধর্মে, সংস্কারে, বিশ্বাসে, আচরণে, বাস্তবে জীবনে, পরিকাঠামোয়, নগরসভ্যতায় সর্বত্র মিলের জায়গা কতোটা ছিল? এতো বিশাল একটা অঞ্চল! এক আইন, এক ভাষা, এক লিপি চালু ছিল সে সময়? না সভ্যতার সর্বত্র সবকিছু একরকম ছিল না। তবে হ্যাঁ অনেক মিলের জায়গাও কিন্তু ছিল। আগে দেখে নিই কোন কোন ক্ষেত্রে মিল ছিল সবচাইতে বেশি।

হরপ্পা সভ্যতার মৌলিক এক বৈশিষ্ট্য বলা যায় একে। হরপ্পা সভ্যতার ইটের মাপ। সমস্ত ক্ষেত্রগুলোয় দেখা গেছে ইটের অনুপাত হল ১:২:৪। আর এক মৌলিক মিলের জায়গা। মাথায় সিং লাগানো এক দেবতাকে পাওয়া গেছে হরপ্পার বিভিন্ন এলাকা থেকে। কোট ডিজিতে একটা জারে এই দেবতার ছবি আঁকা রয়েছে দেখা গেছে। হরপ্পা সভ্যতার অন্যান্য প্রত্নস্থল যেমন রহমান ঢেরি-তে অনেকগুলো এমন ছবি আঁকা জার পাওয়া গেছে। সেগুলি তৈরি হয়েছিল ২৮০০ থেকে ২৬০০ প্রাক সাধারণাব্দ সময়কালের মধ্যে। কালিবঙ্গানে প্রথম দিককার খননে একটা টেরাকোটার কেকের একদিকে এই দেবতার প্রতিমূর্তি পাওয়া গেছে। অপর পিঠে রয়েছে একটা বেঁধে রাখা পশুর প্রতিমূর্তি। উপিন্দর সিং একে সাংস্কৃতিক সমন্বয় বা cultural convergence বলছেন।

সাংস্কৃতিক সমন্বয় অর্থাৎ বিভিন্ন সংস্কৃতি এক জায়গায় এসেছে বলেই এমন কথা বলা যেতে পারে। হরপ্পা সভ্যতার সাংস্কৃতিক বহুত্বের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কার্যত, হরপ্পা সভ্যতার সর্বত্র খাদ্যাভ্যাস, শিল্পের ব্যবহার, ধর্মীয় বিশ্বাস, সংস্কার, সামাজিক অভ্যাস একরকম ছিলও না। যেমন আল্লাহদিনোতে যতগুলো মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে তার মধ্যে মাত্র ১ শতাংশ হল হরপ্পা সভ্যতার বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন লালের উপর কালো মাটির পাত্র। কালিবঙ্গান দুর্গ প্রাকারের দক্ষিণ দিকে যে কাদামাটির ইট দিয়ে তৈরি বেদিটা পাওয়া যায়, যাকে অনেকে  যজ্ঞবেদি বা আগুনের বেদি বলে থাকে, সেটা আর কোনও হরপ্পা সাইটে পাওয়া যায়নি। মৃতদেহ দাফন করার ক্ষেত্রেও বিভিন্ন সাইটের বৈশিষ্ট্য ভিন্ন ভিন্ন। এলাকা ভেদে সমাধিও বৈচিত্র্যময়। হরপ্পা সভ্যতার কবরখানাগুলো পাওয়া গেছে হরপ্পা, কালিবঙ্গান, লোথাল, রাখিগড়ি এবং সুর্কোতাদায়। হরপ্পা সভ্যতায় সাধারণত মৃতদেহ সমাহিত করা হতো লম্ব ভাবে। মাথা উত্তর দিকে। একটা সাধারণ কিংবা ইটের তৈরি কবরে। সঙ্গে খাবার, মাটির বাসন, যন্ত্রপাতি আর গয়নাও সমাধিতে দেওয়া হতো। তবে খুব বেশি তেমন কিছু নয়, খুব একটা প্রাচুর্য থাকতো না। পরিষ্কার কথা হলো হরপ্পা সভ্যতার মানুষরা সম্পদকে মৃতের সঙ্গে সমাহিত করবার তুলনায় জীবনকালে বেশি করে সেসব ব্যবহার করাকে বেছে নিয়েছিলেন। কালিবঙ্গানে সমাধিস্থ করার কাজে সংকেতের ব্যবহার করা হতো। সেখানে অন্যান্য সমাধির দ্রব্য পাওয়া গেলেও দেহাবশেষ পাওয়া যায়নি। হরপ্পা আর মহেঞ্জোদারোতে টুকরো সমাধির খবর মিলেছে। মানে দেহকে পরিবেশে খোলা রেখে দিয়ে, তারপর দেহাবশেষ ও হাড়গোড় একত্র করে পুড়িয়ে ফেলা হতো। এই দুই প্রত্ন ক্ষেত্রে শবাধারেরও সন্ধান মিলেছে। বাস্তবিক হরপ্পা সভ্যতার দেহ সমাধিস্থ করার প্রক্রিয়া বহুমাত্রিক ও বৈচিত্র্যময়।

ইঙ্গিত স্পষ্ট। সমাধির বহুত্ব সংস্কার ও বিশ্বাসের বহুত্বর দিকেই দিকনির্দেশ করে। তাহলে হরপ্পা সভ্যতার ভিত্তি কী? একে আমরা একটা সভ্যতা বলছি কেন? একটা সভ্যতা মানে এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার দিকেই কি ইঙ্গিত দিচ্ছে? বিষয়টা একটু খুঁটিয়ে দেখা যাক।

হরপ্পা সভ্যতায় ধর্মীয় কুসংস্কার সমগ্র সভ্যতাকে এক প্রশাসনিক বাঁধনে বেঁধে রাখতে কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছিল। মনে করেছেন ডি.ডি. কোসম্বি। হরপ্পার অস্ত্রশস্ত্র ভীষণ দুর্বল প্রকৃতির। এদিকে হরপ্পা সভ্যতার বিস্তৃতি হিসাব করলে যা দাঁড়ায়, গোটা অঞ্চলটা এক প্রশাসনের অধীনে সেটা বিরাট ব্যাপার। বিশাল রাষ্ট্র। এতো বড়ো রাষ্ট্র বা প্রশাসন পরিচালনা করতে গেলে তো বলপ্রয়োগের যন্ত্র থাকতে হবে। মানে পুলিশ, সামরিক বাহিনী, জেলখানা এইসব। কিন্তু যেসব অস্ত্রশস্ত্র এখনও পর্যন্ত পাওয়া গেছে সেসব অত্যন্ত দুর্বল। ওসব দিয়ে এতো কিছু করা সম্ভব না। তাহলে বিকল্পে কী ছিল? কোনো বিশেষ সামাজিক ব্যবস্থা?

এদিকে আবার হরপ্পা সভ্যতার নগরগুলো বাণিজ্যনির্ভর ছিল বলে মনে করা হয়। যদি রাষ্ট্রে শক্তিশালী পুলিশ বা মিলিটারি না থেকে থাকে, তাহলে বণিকদের অর্জিত মুনাফা রক্ষা করতো কারা? কীভাবে? সম্ভবত ধর্ম এখানে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল বলে মনে করছেন কোসম্বি। হরপ্পায় ঈশ্বরের বড়ো কোনও মূর্তি পাওয়া যায়নি। তবে কোসম্বির মনে হয়েছে, যে দুর্গ স্তূপটা পাওয়া গেছে সেটাকে মেসোপটেমিয়ার জিগুরাতের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। এদিকে আবার মহেঞ্জোদারোর বিরাট স্নানাগারের সঙ্গে তিনি নিশ্চিতভাবে ধর্মীয় সংস্কারের সংযোগ খুঁজে পেয়েছেন। কারণ বাড়িতে বাড়িতে কুয়ো সহ সুন্দর বাথরুম ছিল। তাছাড়া স্নানাগারের সিঁড়ি বেয়ে দু’কদম গেলেই নদী। আলাদা স্নানের জায়গা কেন দরকার পড়লো?

এদিকে হরপ্পা নিয়ে নিজের বিস্তৃত রিপোর্টে জন মার্শাল আর একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। এই সভ্যতায় কোনও আত্মরক্ষামূলক বর্মের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়নি। এবার নীডহ্যামকে অবলম্বন করে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় বলছেন, অন্যান্য অস্ত্র সহ তীর-ধনুকের ব্যবহার হরপ্পা সভ্যতায় ছিল। কম হলেও ছিল। শিকারের যুগ থেকে তীর-ধনুক ব্যবহার চলে আসবার কথা কোসম্বি বলেছেন। কিন্তু সেসব তো সাধারণ কৃষকদের হাতেও ছিল। শুধু শাসকশ্রেণির হাতে ছিল এমন তো নয়। সামরিক প্রযুক্তিবিদ্যার দিক থেকে এমন ক্ষেত্রে আত্মরক্ষামূলক ঢালের বা বর্মের গুরুত্ব অপরিসীম। মূল গুরুত্ব সেখানেই। এবার হরপ্পায় সেই আত্মরক্ষার বর্মও অনুপস্থিত। তাই দেবীপ্রসাদ সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, সেক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ হিংসা বাদে অন্য কোনও ব্যবস্থা নিশ্চয়ই ছিল জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করবার জন্য। নিঃসন্দেহে ইঙ্গিত ধর্মের দিকে।

তব সেনাবাহিনী কি হরপ্পায় সত্যিই ছিল না? হরপ্পায় রাজতন্ত্র ছিল তেমনও এক ইঙ্গিত কিন্তু পাওয়া গেছে। মধুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায় লিখছেন, “মেসোপটেমিয়ার প্রাচীন কাহিনীতে পাতালের দেবতার নাম দেওয়া হয়েছে এনকি। এই পাতালের দেবতা এনকি যে কয়েকটা এলাকায় তাঁর আশীর্বাদ বর্ষণ করেছে, তার মধ্যে রয়েছে মেসোপটেমিয়া, পশ্চিম ও উত্তরের স্তেপভূমি আর মেলুহাহদের দেশ। মেলুহাহদের উদ্দেশ্যে এনকির আশির্বাণী হল, ‘কালো দেশ, তোমার বৃক্ষরাজি হোক সুউচ্চ, রাজপ্রাসাদে সিংহাসন সদা পূর্ণ থাকুক… যুদ্ধক্ষেত্রে তোমার বীর নায়করা তাদের অস্ত্রে ভূলোকজয়ী হোক; তোমার বৃষদল হয়ে উঠুক বিশাল আকৃতির… তোমার পক্ষীকুল হোক ‘হাজা’ পক্ষী, তাদের কলরবে সদা মুখরিত হোক রাজপ্রাসাদ।’” ইঙ্গিত স্পষ্ট হলেও কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়। মেসোপটেমিয়ার আর্থ-সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে এই আশির্বাণী এসেছে বোঝা যায়। রাজপ্রাসাদের সিংহাসন কিংবা যুদ্ধক্ষেত্রের বীর নায়কদের কথা মেলুহাহ কিংবা হরপ্পার উপর আরোপিত নয় তো? সেসব হরপ্পায় ছিলই এই আশীর্বাদের কথার থেকে তেমন কোনও সিদ্ধান্ত সুনিশ্চিতভাবে নেওয়া যায় কী!

রাজা বা সেনাবাহিনী হরপ্পায় ছিল কী ছিল না, থাকলেও কোন চেহারায় ছিল, এ প্রশ্নের সত্যিকারের জবাব দেওয়ার মতো তথ্য কিন্তু এখনও আমাদের হাতে নেই। তবে হ্যাঁ কোনও একটা কর্তৃপক্ষ তো ছিলই। কেন বলতে পারছি এমন কথা? আসলে হপ্পার নগর সভ্যতা গড়ে উঠবার মধ্যেই এর উত্তর লুকিয়ে আছে। প্রখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ গর্ডন চাইল্ড ৬০০০ থেকে ৩০০০ সাধারণ পূর্বাব্দের মধ্যে মানব সভ্যতার এক গুরুত্বপূর্ণ বিকাশের কথা তুলে ধরেছেন। এই সময়ে মানুষ চাকাওয়ালা গরুর গাড়ি, লাঙল, পালতোলা নৌকা ইত্যাদি আবিষ্কার করেছে। আকরিক তামাকে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় ফেলে ধাতু সংগ্রহ করতে শিখেছে। শিখেছে ধাতুর ভৌত ধর্ম কেমন হয়। তখন মানুষ দৌড়চ্ছে একটা নিখুঁত সৌর ক্যালেন্ডার বা পাঁজি তৈরি করার লক্ষ্যে। নগরজীবনের জন্য এই পর্যায়ে মানুষ নিজেকে প্রস্তুত করে ফেলেছে। এমন এক সভ্যতায় তারা পৌঁছেছে যেখানে প্রয়োজন মাপা এবং ওজন করবার একটা সাধারণ মানদণ্ড, লিখতে পারা এবং হিসাব করতে জানা। প্রয়োজন ছিল অর্জিত জ্ঞানকে সকলের মধ্যে এবং প্রজন্মান্তরে প্রবাহিত করবার নতুন নতুন মাধ্যমগুলি শিখবার এবং আয়ত্ত করবার।

হরপ্পার পরিপ্রেক্ষিতও এর থেকে আলাদা ছিল না। আসলে হরপ্পা ছিল মানব সভ্যতার ইতিহাসে প্রথম নগরবিপ্লব বলে পরিচিত যে বিখ্যাত ঘটনা ঘটে তার সঙ্গে স্পষ্টত সংশ্লিষ্ট।

৬০০০ থেকে ৩০০০ প্রাক-সাধারণাব্দ সময়কাল। এই উঠতি নগর কেন্দ্রগুলির জন্য প্রয়োজন পড়েছিল বিভিন্ন কাজে যারা বিশেষজ্ঞ, তাঁদেরকে আকর্ষণ করবার। সর্বক্ষণের জন্য যাতে তাঁরা নিশ্চিন্তে নিজেদের কাজ করতে পারেন সেটা নিশ্চিত করবার। পেশাদার শিল্পী আর কারিগর, আরও কত নতুন নতুন উদ্ভাবন। সেসব মানুষকে নগরের স্থায়ী বাসিন্দা বানানোর প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেটা করা হবে কীভাবে? কৃষির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে খাদ্য উৎপাদন করবার পাশাপাশি এইসব গ্রামীণ বিশেষজ্ঞরা উদ্বৃত্ত সময়ে এসব আবিষ্কার-উদ্ভাবনের কাজ করতেন। জ্যোতির্বিদ্যা, লিপির ব্যবহার, দাঁতের প্রাক চিকিৎসার ভাবনা সবটাই এভাবেই চলতো। এমন বিশেষজ্ঞদের নগরে নিয়ে এসে সর্বক্ষণ যাতে তারা উদ্ভাবনের কাজ বা চিন্তা করতে পারেন সেটা নিশ্চিত করবার কিছু সমস্যা ছিল। প্রধান সমস্যা এই যে, গ্রামে তো এঁরা উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নগরে চলে এলে তাঁরা আর উৎপাদনে হাত লাগাতে পারবেন না। আবার নগরে তাঁদের সর্বক্ষণের জন্য উদ্ভাবনের কাজে লাগাতে গেলে প্রয়োজন ছিল গ্রামে যে উৎপাদন হয়, সেই উৎপাদনের উদ্বৃত্তকে এই উঠতি নগর কেন্দ্রগুলিতে নিয়ে এসে জমা করবার একটা ব্যবস্থা করার। কারণ সেই জমা উদ্বৃত্ত থেকে সর্বক্ষণের বিশেষজ্ঞদের থাকা-খাওয়ার-বেঁচে থাকবার রসদের জোগান দিতে হবে। এটা যেকোনো নগর গড়ে তোলবার ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা করবার জন্য তাই প্রয়োজন ছিল একটা মতাদর্শের। সেই যুগের কথা মাথায় রাখলে প্রয়োজন ছিল এমন এক মতাদর্শ, যা এই সমস্ত প্রয়োজনকে সুচারুভাবে মেটাতে পারে। সেই যুগের সাপেক্ষে এই মতাদর্শ হিসাবে সামনে এলো ধর্ম। ধর্মীয় বিশ্বাস আর অনুশীলন। এই ধর্মীয় দুটো কাজ করবে। এক, গ্রামের মানুষ নির্বিবাদে তাদের উৎপাদন করা উদ্বৃত্ত শহরকে দিয়ে দেবে ধর্মের নামে। আবশ্যিক কর্তব্য হিসাবে দেখবে সেটাকে। আর দুই, ধর্মের মাধ্যমে সমগ্র সভ্যতার মানুষকে একটা মূল্যবোধে বেঁধে ফেলে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। কষ্টের শ্রমের উৎপাদন নগরে ফোকটে চলে যাচ্ছে, সে নিয়ে কোনও প্রশ্ন তো আর আসবেই না। বরং সেটাই হয়ে যাবে প্রচলিত নিয়ম। এই যে ধর্ম ব্যাপারটার উত্থান ঘটেছিল ৬০০০ থেকে ৩০০০ প্রাক-সাধারণাব্দে, সেটার ভিত্তি কিন্তু গড়ে দিয়েছিল আদিম সেই জাদুবিশ্বাস। কীভাবে? আসলে এই প্রাচীন জাদুবিশ্বাস জড়িয়ে পড়েছিল ভয়াবহ এক আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে। একদিকে এই জাদু বিশ্বাস একটা কাল্পনিক পদ্ধতি তৈরি করেছিল। বাস্তবকে নকল করার। যা কার্যত কাল্পনিক পদ্ধতি হলেও, বাস্তবে যে কার্যকর পদ্ধতির প্রয়োজন তার পরিপূরক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর সমস্ত কাজের ভিত্তি ছিল যৌথতা। যৌথতা যদি ভিত্তি হয়ে থাকে, তাহলে সেটার পরিবর্তে নগর বিপ্লব জাদুবিশ্বাসের এক নতুন সামাজিক-অর্থনৈতিক ভূমিকা নিয়ে এলো। কী ভূমিকা? জাদুবিশ্বাসের কাল্পনিক দিককে কাজে লাগিয়ে গ্রামের উদ্বৃত্ত শহরে চালান করবার ব্যবস্থাপনা করা। যৌথতার দিকটাকে হত্যা করা হলো। বাড়িয়ে দেওয়া হলো কল্পনার দিক। আর সেই কল্পনার দিক প্রকৃতিকে নকল করবার পর প্রয়োজন মেটানোর আদেশ আর করে না। পরিবর্তে মাথা নুইয়ে করুণা ভিক্ষা চায়। ঠিক যেভাবে প্রবল শাসকের সামনে মাথা নোয়াতে হয় মানুষকে সাধারণ অধিকার বা ন্যুনতম প্রয়োজনটুকু মেটানোর তাগিদে। এভাবেই জাদুবিশ্বাসের গর্ভ থেকে জন্ম হলো ধর্মের।

হরপ্পার ক্ষেত্রেও অস্ত্র বা আত্মরক্ষার বর্মের অভাব আরও বেশি করে ইঙ্গিত দেয় খুবই শক্তিশালী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতির দিকে। সুতরাং যৌথ সমাজের জাদুর দেশ বদলে গেল শ্রম শোষণের দেশে। ধর্ম এনে দিল শ্রম শোষণ করবার সামাজিক-সাংস্কৃতিক বৈধতা। জাদুবিশ্বাস থেকে ধর্ম, বিবর্তনের অনুঘটক হলো নগরবিপ্লব।

আচ্ছা হরপ্পার বিভিন্ন নগর এবং সভ্যতার পরিসরের অন্যান্য এলাকা কি কোনও নির্দিষ্ট একটা কেন্দ্রীয় প্রশাসনের অধীন ছিল? না, এমন কোনও কেন্দ্রীয় প্রশাসনের প্রামাণ্য খবর কিন্তু পাওয়া যায়নি। তবে এই প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক রোমিলা থাপারের কিছু ধারণা রয়েছে। তিনি বলছেন প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন নগরের শাসক ছিলেন আঞ্চলিক গোষ্ঠীপতিরা। মানে হরপ্পা সভ্যতা গড়ে ওঠার পর্যায়ে। সভ্যতা যখন পরিণত পর্যায়ে পৌঁছল তখন বিভিন্ন নগরের গোষ্ঠীপতিরা সম্ভবত বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার জন্য একত্রিত হতেন। সেখান থেকে মৌলিক পরিকল্পনাগুলি করা হতো। অনুমান কতটা সঠিক কতটা নয়, বলা মুশকিল। তবে মনে করিয়ে দিই কোসম্বির সেই মিশ্র টোটেমের কথা। হরপ্পার সিলে একাধিক প্রাণির ছবি খোদাই করা। এক একটা প্রাণি যদি এক একটা গোষ্ঠীর টোটেম হয়, তাহলে কোসম্বির মিশ্র টোটেম হলো দুই পৃথক গোষ্ঠীর কাছাকাছি আসার চিহ্ন। সম্ভব যে তাদের গোষ্ঠীগত যৌথতায় গড়ে উঠেছে এক বা একাধিক নগর। এর সঙ্গে ঐতিহাসিক রোমিলা থাপারের অনুমান জুড়লে নগরগুলির পরিচালনায় বিভিন্ন গোষ্ঠীর যৌথ সিদ্ধান্ত গ্রহণের অনুমানটিও বাস্তবে ঘটা সম্ভবপর বলা যায়।

হরপ্পার শাসন শ্রেণি ছিলেন পুরোহিত ও বণিকরা, মনে করেছেন কোসম্বি। প্রসঙ্গত হরপ্পার লিপি সম্বন্ধে তিনি নিজের ধারণার কথা জানিয়েছেন। তাঁর ধারণায় হরপ্পার অধিবাসীদের নিজস্ব কোনও বর্ণমালা ছিল না। কিউনিফর্ম ও ফিনিশীয় লিপিকে সাধারণীকরণ করে তাঁরা গ্রহণ করেছিলেন। তবে তাঁর অনুমানের জরুরি দিকটি হলো এই লিপি কিন্তু মুষ্টিমেয় পুরোহিত বা বণিক শ্রেণির একচেটিয়া অধিকারে আটকে থাকেনি। অক্ষরজ্ঞান সাধারণ মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে গিয়েছিল।

আর একটা বিষয়ে তথ্য মজুত আছে। মেসোপটেমিয়ার লিপি থেকে জানা যাচ্ছে মেলুহাহ কিংবা হরপ্পার থেকে দাস আমদানির খবর। তাছাড়া হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো খনন করে দুই কামরার ছোটো ছোটো কক্ষ পাওয়া গেছে। সুবীরা জয়সওয়াল এসবের সঙ্গে তুলনা টেনেছে আজকের যুগের কুলি লাইনের। ওখানে বাস করতেন যে দাসরা, তাঁরা শস্য পেষাই করতেন বলে তাঁর অনুমান। যাইহোক এই অনুমান ও তথ্য থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে না হরপ্পা সভ্যতায় দাসব্যবস্থা ছিল কিনা। তবে শ্রমজীবী মানুষদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা দেখে বোঝা যায় শ্রেণিগত বৈষম্য ভালোভাবেই ছিল সেখানে।

নগর সভ্যতা হরপ্পার ভিত্তি ছিল, গ্রাম এলাকার উদ্বৃত্ত সম্পদ দখল করে শহুরে পেশাদারদের লালন করা, যাতে তাঁরা নিজেদের পেশার কাজে সর্বক্ষণ সময় দিতে পারেন, এ বিষয়ে আগেই আলোচনা করেছি। এবার দেখা যাক হরপ্পার উদ্বৃত্ত সম্পদের বণ্টন নিয়ে মধুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের মতামতে কী বলছেন? তাঁর মতে, “হরপ্পীয় সভ্যতায় ছিল শস্যাগার, স্নানাগার, জলাধার। আর মিশরে ছিল সুবিশাল পিরামিড, অতিকায় রাজমূর্তি ও সোনার স্তূপ; মেসোপটেমিয়ায় পাওয়া গেছে ইস্থার গেট ও অভিজাত মন্দির। হরপ্পীয় সভ্যতার কোন প্রত্নস্থলেই প্রচুর সোনা বা রূপা পাওয়া যায়নি। ওদের খাবার পাত্রগুলি ছিল মিশর ও মেসোপটেমিয়ার তুলনায় নিরলঙ্কার, কারুকার্যহীন। এখানে স্পষ্টতই এক দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য আছে ওরা সোনা কেন্দ্রীভূত না করে বাণিজ্যের কাজে, নগর উন্নয়নে ব্যবহার করেছে। অথবা হয়তো ওদের উদ্বৃত্ত সম্পদ ছিল তুলনামূলকভাবে কম। কিংবা ওদের সম্পদের বণ্টন এমন ছিল যে কারো হাতেই বিশাল ঐশ্বর্য জমা হয়নি।” দ্বিতীয় সম্ভাবনা কম বলেই মনে হয়। কারণ এতো বিস্তৃত একটা সভ্যতার কেন্দ্রীয় শাসক যে বা যাঁরাই হোন, সাধারণ মানুষের তুলনায় তাঁরা বিশাল ঐশ্বর্যশালী ছিলেন না, এমনটা ভাবা কঠিন বলে মনে হয়েছে আমার। তবে বিভিন্ন নগর কেন্দ্রের গোষ্ঠী প্রধানদের সমবেতভাবে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার যে সম্ভাবনার কথা রোমিলা থাপার বলেছেন, তা সত্যি হলে উদ্বৃত্ত সম্পদ একচেটিয়া না হয়ে প্রভাবশালী এই গোষ্ঠী প্রধানদের মধ্যে মোটামুটি সাযুজ্য বজায় রেখে বণ্টিত হতো, এমন একটা সম্ভাবনা থেকে যায়। তবে সাধারণ মানুষ আর শাসকের মধ্যে সম্পদের বণ্টনের ফারাক খুব কম ছিল বলে মনে হয় না। বিপুলকায় ইমারতের পাশে ছোটো ছোটো দুই কক্ষের ঘরগুলোর উপস্থিতি, যাকে সুবীরা জয়সওয়াল বর্তমান যুগের কুলি লাইনের সঙ্গে তুলনা করছেন, তেমন ইঙ্গিতই কিন্তু দেয়। বরং এটা সত্যি যে, হরপ্পায় পিরামিড বা জিগুরাতের মতো বড়ো কোনও স্থাপত্য দেখতে পাওয়া যায় না, কোনও মূল্যবান ধাতুর বিপুল ভাণ্ডারও না। সেক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের জায়গা একটা রয়েছে এমন মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তবে কেন এমন দৃষ্টিভঙ্গি, অথবা উপস্থিত দৃষ্টিভঙ্গির চেহারা কেমন, এসব প্রশ্নের খুব স্পষ্ট উত্তর আপাতত আমাদের কাছে নেই বলে মনে হয়।

এদিকে দামোদর ধর্মানন্দ কোসম্বি প্রাগার্য সভ্যতায় চতুর্বর্ণ ব্যবস্থার খুব ক্ষীণ হলেও হদিশ পেয়েছেন। কোসম্বি বলছেন, হরপ্পা সভ্যতার ওজন নেওয়ার পরিমাপ প্রায় নিখুঁত ছিল, নগরব্যবস্থা অত্যন্ত উন্নত ছিল, কিন্তু বলবার মতো তেমন কোনও অস্ত্রশস্ত্রের সন্ধান মেলেনি। তাই দ্বিতীয় প্রাক-সাধারণাব্দে আর্য আক্রমণে এই সভ্যতা ধ্বংস হয় বলে তাঁর মত। তিনি অনুমান করছেন, কয়েক শতক জঙ্গলে আধপেটা খেয়ে বেঁচে থাকা কোনও একটি হেরে যাওয়া গোষ্ঠী বিজয়ীদের পুরোহিত হয়ে উঠেছিল। গঠন করেছিল পুরোহিত বর্ণ। হরপ্পার পরাস্ত কোনও গোষ্ঠীর কথা বলছেন এখানে। তঁার অনুমান এঁরা ভার্গব ব্রাহ্মণ। এই অনুমানের ভিত্তি কী তা অবশ্য স্পষ্ট নয়। এদিকে বিজয়ী আর্যরা যোদ্ধা হিসাবে ক্ষত্রিয় বলে পরিচিত হন। প্রাচীন কাল থেকেই বণিক শ্রেণি ছিল। আর্যদের মধ্যে না থাকলেও পরাজিত হরপ্পা সভ্যতার মানুষের মধ্যে তো ছিলই। এই অনুমানে অধিকাংশ ঐতিহাসিক সায় দিয়েছে। পশ্চিমের মতো বিক্রির পণ্যে পরিণত না হলেও সমাজের বাকি অংশ পরিণত হয় দাসে। এরাই হলো শূদ্র। এখানেও নির্ঘাত তিনি হরপ্পার বাসিন্দাদের কথাই বলেছেন। সে যাই হোক, কোসম্বির অনুমান থেকে হরপ্পা সভ্যতায় বর্ণভেদ ছিল এমনটা কিন্তু প্রমাণিত হয় না। বরং আর্য আক্রমণে হরপ্পা সভ্যতার পতনের মধ্য দিয়ে পরবর্তীকালে চতুর্বর্ণ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে বলেই দেখতে পাওয়া যায়। একমাত্র ক্ষত্রিয় বর্ণ ছাড়া বাকি সকলেই হরপ্পার উত্তরাধিকারী সেক্ষেত্রে।

বর্ণের উদ্ভব সংক্রান্ত এই আলোচনায় আপাতত ঢুকছি না। এখানে কোসম্বির ধারণার কথা তুলে ধরলাম মাত্র। তিনি হরপ্পা সভ্যতা ধ্বংসের কারণ হিসাবে  আর্য আক্রমণের কথা বলেছেন। যদিও বর্তমানে বেশিরভাগ ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক মনে করেন না, আদৌ এমন কোনও ঘটনা ঘটেছিল। আর্য আক্রমণ তত্ত্ব মানলে কিংবা না মানলেও, এই তত্ত্বের মধ্যে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে যা আমাদের ভারতের সভ্যতার মুখ্যধারা বিষয়ক চর্চাকে সমৃদ্ধ করবে। তাই এই প্রসঙ্গে একটু বিস্তারিত আলোচনায় আমরা যাবো। তবে তার আগে পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা দেখার চেষ্টা করবো হরপ্পার সংস্কৃতির কী কী উত্তরাধিকার আমরা বহন করে চলেছি আজও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *