কোবাড গান্ধী
মূল লেখাটি ইংরাজিতে মেন্সট্রীম উইকলি পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৮ অক্টোবর, ২০২৫
https://www.mainstreamweekly.net/article16325.html
সোনুর আত্মসমর্পণের ঘটনাকে শাসক শ্রেণীর বেশিরভাগ অংশ এমনভাবে উদযাপন করছে যেন বিপ্লবী আন্দোলনের এখানেই সমাপ্তি ঘটলো। বিপ্লবী আন্দোলনের জন্য নিঃসন্দেহে এই ক্ষতি উল্লেখযোগ্য মাত্রার, কিন্তু চলমান ব্যবস্থার প্রতি ব্যাপক জনগণের অসন্তোষের মূল কারণগুলো কিন্তু আগের মতোই বা আগের চেয়েও বেশী তীব্র বলা যায়। ফলে যতক্ষণ না সেসব নির্মূল করা হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত বিপ্লবী আন্দোলনের বারবার উত্থান ঘটতে দেখা যাবে – অন্ধকার গভীর কূপের ভিতর থেকে যেভাবে একটা হাইড্রা-শূড় ওয়ালা দানব উঠে আসে, সেভাবেই একদিন জেগে উঠে শাসক অভিজাতদের ঘাড় মটকাবে। যদি আজকে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, তবে কাল তা আরও মরিয়া চেহারা নিতে পারে যা অভিজাতদের রাতের ঘুম কেড়ে নেবে। প্রতিরোধ যতক্ষণ পরিকল্পিত এবং নিয়ন্ত্রিতভাবে চলছে, ততক্ষণ বেশিরভাগ সাধারণ মানুষের ভয়…
[5:56 pm, 22/10/2025] Sonu: প্রসঙ্গ সোনুর আত্মসমর্পণঃ ঘটনার তাৎপর্য আদৌ কতটা?
সোনুর আত্মসমর্পণের ঘটনাকে শাসক শ্রেণীর বেশিরভাগ অংশ এমনভাবে উদযাপন করছে যেন বিপ্লবী আন্দোলনের এখানেই সমাপ্তি ঘটলো। বিপ্লবী আন্দোলনের জন্য নিঃসন্দেহে এই ক্ষতি উল্লেখযোগ্য মাত্রার, কিন্তু চলমান ব্যবস্থার প্রতি ব্যাপক জনগণের অসন্তোষের মূল কারণগুলো কিন্তু আগের মতোই বা আগের চেয়েও বেশী তীব্র বলা যায়। ফলে যতক্ষণ না সেসব নির্মূল করা হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত বিপ্লবী আন্দোলনের বারবার উত্থান ঘটতে দেখা যাবে – অন্ধকার গভীর কূপের ভিতর থেকে যেভাবে একটা হাইড্রা-শূড় ওয়ালা দানব উঠে আসে, সেভাবেই একদিন জেগে উঠে শাসক অভিজাতদের ঘাড় মটকাবে। যদি আজকে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, তবে কাল তা আরও মরিয়া চেহারা নিতে পারে যা অভিজাতদের রাতের ঘুম কেড়ে নেবে। প্রতিরোধ যতক্ষণ পরিকল্পিত এবং নিয়ন্ত্রিতভাবে চলছে, ততক্ষণ বেশিরভাগ সাধারণ মানুষের ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই – কেবল শীর্ষস্থানীয় বড় বড় ব্যবসায়ী এবং বৃহৎ জমির মালিক শ্রেণী এবং তাদের রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রতিনিধিরা নিঃসন্দেহে দুঃস্বপ্নের রাত কাটাবে।
আসুন, দেশের সার্বিক পরিস্থিতির দিকে এক ঝলক নজর দিই। এর থেকেই বোঝা যাবে – স্বাধীনতার প্রায় ৮০ বছর পরেও – জনগণের অসন্তোষের মূল কারণ কী:
যদিও আমরা বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ বৃদ্ধির হার আমাদের বলে আজকাল গর্ব করে থাকি – এবং বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৫/২৬ অর্থবছরে ভারতের বৃদ্ধির হার ৬.৩ শতাংশে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে। সেই একই সময় দাঁড়িয়ে কিন্তু দেখা যাচ্ছে অন্যান্য বাস্তব তথ্য বেশ হতাশাজনক: জাতিসংঘের বৈশ্বিক বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক ২০২৪ অনুসারে: ভারতে এখনও দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি – ২৩৪ মিলিয়ন; পাকিস্তানের ৯৩ মিলিয়ন; ইথিওপিয়ার ৮৬ মিলিয়ন এবং নাইজেরিয়ার ৭৪ মিলিয়ন। যদিও পরিসংখ্যানগুলি তুলনামূলক নাও হতে পারে (ভারতের বর্তমান জনসংখ্যা ১,৪৬৬ মিলিয়ন বা প্রায় ১৪৭ কোটি), একেবারে অমানবিক পরিস্থিতিতে বসবাসকারীদের সংখ্যা ভারতে বিস্ময়কর রকম বেশি। বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে, ১২৭টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১০৫। ইউএনডিপি গ্লোবাল পভার্টি ইনডেক্স অনুসারে, ২০২৪ সালের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী ১.১ বিলিয়ন মানুষ চরম দারিদ্র্যের (বহুমাত্রিক দারিদ্র্য) মধ্যে বাস করে; যার মধ্যে ভারত শীর্ষ স্থানে রয়েছে।
ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ (২০২৫) অনুসারে, ভারতে প্রায় ২০ লক্ষ গৃহহীন মানুষ রয়েছে – অর্থাৎ যারা হলেন পথবাসী। এছাড়াও, ভারতের প্রায় ৭৮ মিলিয়ন মানুষ বস্তিতে বাস করে – সারা পৃথিবীর বস্তিবাসীদের ১৭% ভারতে বাস করে।
দারিদ্রের নমুনা আরো দেওয়া যেতে পারে। তবে শুধুমাত্র এটাই কিন্তু মূল কারণ নয়: ভারত বিশ্বের কিছু ধনীরও আবাসস্থল, এবং প্রতিদিন ধনী-দরিদ্রের এই ব্যবধান বাড়ছে।
ভারতে কমপক্ষে ২ লক্ষ মানুষ বার্ষিক ১ কোটি টাকারও বেশি আয় করেন, যেখানে গড় পারিবারিক আয় ১০,০০০ টাকারও কম। ২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ১৬৭ লক্ষ কোটি টাকার সম্পদ ছিল মোট ৩৫০ জন বিলিয়নেয়ারের । মুকেশ আম্বানির ১০ লক্ষ কোটি টাকার সম্পত্তি এবং আদানির সম্পত্তি ৮ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি। এবং এটি কেবল ঘোষিত আয়; এর সাথে কেউ যদি কালো টাকার পরিমাণ বিবেচনা করেন, তবে তা এই পরিসংখ্যানের কমপক্ষে তিনগুণ হবে। (কিছু অর্থনীতিবিদদের অনুমান অনুসারে, ভারতের কালো অর্থনীতি জিডিপির ৬২% বা ৯৩ লক্ষ কোটি টাকা বলে অনুমান করা হয়; তবে এও একটি রক্ষণশীল পরিসংখ্যান )। এই কালো টাকার বেশিরভাগটাই শীর্ষ বিলিয়নেয়ারদের কাছে যাবে, যা ব্যবধানকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে তুলবে।
অন্য কথায়, কোটিপতিদের মোট সম্পদ হবে সর্বনিম্ন ২৫০ লক্ষ কোটি টাকা – অর্থাৎ ৩৫০টি পরিবার যাদের প্রায় ২৫০ লক্ষ কোটি টাকা সম্পদ; অথবা প্রতিটি পরিবার যাদের ৭,০০০ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। এর তুলনা ভারতের মাথাপিছু আয়ের সাথে করুন, যেখানে বার্ষিক মাত্র ১ লক্ষ টাকা বা মাসিক প্রায় ৮,০০০ টাকা। (এবং মাথাপিছু আয় আসলে একটা গড় পরিমাপ যার মধ্যে শীর্ষ কোটিপতিদের আয়ও অন্তর্ভুক্ত)। ভারতীয় জনসংখ্যার নীচের অর্ধেকের কাছে জাতীয় সম্পদের “প্রায় কিছুই নেই”, ফ্রান্সের থমাস পিকেটি সহ সিনিয়র অর্থনীতিবিদদের দ্বারা রচিত একটি প্রতিবেদনে এ কথাই দাবি করা হয়েছে। শীর্ষ ১০% নীচের ৫০% এর চেয়ে প্রায় ২০ গুণ বেশি আয় করে। মানি কন্ট্রোলে (৭ ডিসেম্বর, ২০২১) (একই প্রতিবেদনে) আরও বলা হয়েছে: “যদিও জনসংখ্যার শীর্ষ ১ শতাংশ মোট জাতীয় আয়ের ২২ শতাংশ ধারণ করে, নীচের অর্ধেকের অংশীদারি ১৩ শতাংশে নেমে এসেছে”।
যতদিন এই পরিস্থিতি চলতে থাকবে, ততদিন দেশে অসন্তোষ থাকবে। আর অসন্তোষ থাকলে প্রতিরোধও থাকবে। সোনুর ভাই কিষাণজি এবং আরও শত শত মানুষের শাহাদাতও বৃথা যাবে না। যদি লুটেরা সরকার এবং তাদের কর্পোরেট কর্তারা এই ধারা অব্যাহত রাখেন, তাহলে জনগণ বিদ্রোহ করবেই। কিন্তু যদি এমন একটি জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় যা মুষ্টিমেয় বড় ব্যবসায়ীদের এবং সরকার, আমলাতন্ত্র এবং রাজনৈতিক দলগুলিতে তাদের এজেন্টদের অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদ দখল করে, তাহলে এটি লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা সংগ্রহ করতে পারে যা কৃষি এবং ক্ষুদ্র শিল্পে বিনিয়োগ করা যেতে পারে, যা ভারতকে প্রায় এক শতাব্দী ধরে পশ্চাদপদতায় ডুবে থাকার পরিবর্তে সত্যিকারের দ্রুত উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
ভারতের ২০০ জন বিলিয়নেয়ারের সম্পদ কেবল বাজেয়াপ্ত করলেই ৯৪১ বিলিয়ন ডলার (৮০ লক্ষ কোটি টাকা) আসবে। আর এটা কেবল সাদা (ঘোষিত) টাকা। যদি কালো টাকাও যোগ করা হয় তাহলে সংখ্যাটা সম্ভবত ২০০ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি হবে। আর যদি এর সাথে সাম্রাজ্যবাদীদের সম্পদ যোগ করা হয়, তাহলে এই পরিমাণটা অবাক করার মতো হবে (গত দশকে বিদেশী প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের (FII) পরিমাণ ছিল ১ ট্রিলিয়ন ডলার যেখানে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (FDI) ছিল ৫০০ বিলিয়ন ডলার)।
যদিও এই বিশাল বিনিয়োগের ফলে সুদ এবং অন্যান্য পথেও দেশের সম্পদের বিশাল পরিমাণ পাচার হয়। ফলে বিকল্পের কথা বলতে গেলে উদাহরণ হিসেবে বলি, যদি এই বিশাল পরিমাণ অর্থ বাজেয়াপ্ত করা হয়, যার পরিমাণ প্রায় ৩ ট্রিলিয়ন ডলার (বিলিওনেয়ারদের সম্পদ+FDI+FII) এবং উপরে বর্ণিত হিসাবে পুনরায় বিনিয়োগ করা হয়, অর্থাৎ কৃষি এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ক্ষেত্রে (SSI-তে), শুধু তাহলেই ভারতের কি বিশাল বৃদ্ধি হতে পারে সেই সম্ভাবনার কথা একবার কল্পনা করুন। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে ভারত একটি পশ্চাদপদ দেশ থেকে একটি উন্নত দেশে পরিণত হবে, ঠিক যেমনটি চীন করে দেখিয়েছে।
তাই, কিষাণজি, বাসবরাজু ইত্যাদির মতো কয়েকজন বিপ্লবীকে হত্যা করা, অথবা কিছু বিপ্লবীকে আন্দোলন ত্যাগ করতে বাধ্য করা, এবং একই সাথে বৃহৎ কর্পোরেট, সাম্রাজ্যবাদী এবং অতি-ধনীদের (রাজনীতিবিদ, কালোবাজারি ইত্যাদি সহ) অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদ (সাদা এবং কালো) রক্ষা করার প্রক্রিয়া আসলে ভারত রাষ্ট্রের ক্রমাগত পশ্চাদপসরণকেই কেবল স্থায়ী করবে। অর্থাৎ বেশিরভাগ মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করতে থাকবে, মুষ্টিমেয় শকুন ফুলে ফেঁপে উঠবে। এই ব্যবস্থা কোনওমতেই টেকসই নয়।

